ভারতকে ১৬৮ রানের নাগালে রেখে যে সুযোগ এসেছিল বাংলাদেশের সামনে, গতকাল ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় তা ভণ্ডুল হয়ে গেছে। দুবাইয়ে এদিন ৪১ রানে হেরেছেন জাকেররা। তবে এই হারের জন্য হাহুতাশ করার সময়ও নেই। ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে আজ একই মাঠে পাকিস্তানের বিপক্ষে নামতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। নকআউট এই ম্যাচটি জিতলেই ফাইনালে চলে যাবে বাংলাদেশ। এদিন জাকেরদের হারে শ্রীলঙ্কার বিদায়ও নিশ্চিত হয়ে গেছে।
ভারত ম্যাচের ভুলগুলো শুধরেই নামতে হবে পাকিস্তানের বিপক্ষে। ভালো খবর এই, ম্যাচটিতে খেলার জন্য প্রস্তুত ফিট অধিনায়ক লিটন কুমার দাস। গতকাল যিনি ড্রেসিংরুমের সামনে বসে শুধুই আক্ষেপ করেছেন। এক সাইফ বাদে দলের কোনো ব্যাটার ২০ বলের বেশি ক্রিজে থাকতে পারেননি। অথচ বোলাররা কী দারুণ সুযোগই না তৈরি করে দিয়েছিলেন! ভাগ্যও একেবারে মন্দ ছিল না। সাইফ তাঁর ৬৯ রানের পথে চার চারবার জীবন পেয়েছিলেন। বাকিদের কেউ একজন তাঁর সঙ্গে ইনিংস গড়তে পারলে আজকের ম্যাচের জন্যও আত্মবিশ্বাস বাড়ানো থাকত। তবে এদিনের ম্যাচে বোলারদের কিছু স্পেল আশা দিয়েছিল।
অভিষেকের ক্যাচ মিসের আফসোস থাকলেও, তাঁর সঙ্গে জাকেরকে সূর্যকুমার যাদবকে তালুবন্দি করার স্বস্তিও ছিল। রিশাদের গুগলির সঙ্গে দারুণ ফিল্ডিংয়ে রানআউট করার মুগ্ধতাও ছিল। তবে সবকিছু বোধ হয় ছাপিয়ে গিয়েছিল শেষ ওভারটিতে সাইফউদ্দিনের ওয়াইড ইয়র্কারগুলো।
এদিন ভারতের রান তাড়া করতে নেমে প্রথম ওভারে হার্দিককে দেখেশুনে ছেড়ে দেন দুই ওপেনার। তবে বুমরাহকে ফ্লিক করতে ক্যাচ দিয়ে বসেন তানজিদ তামিম। কিন্তু সেই বুমরাহকেই পরে ছক্কা হাঁকান পারভেজ ইমন। বরুণ চক্রবর্তীকে বাউন্ডারি ছাড়া করেন সাইফ। পাওয়ার প্লেতে পাঁচ বাউন্ডারির সঙ্গে একটি ওভার বাউন্ডারি। যার প্রতিটি শট আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ছিল। কিন্তু বাউন্ডারির সেই ফ্লো কমে যায় ছয় নম্বর ওভারটি থেকে। আসলে আউট ফিল্ড স্লো থাকায় ছক্কার ওপর জোর দেওয়ার কৌশল নিয়েছিলেন ব্যাটাররা। আর তখনই কুলদীপ যাদবের শর্টার লেন্থের বল তুলে মারতে গিয়ে ক্যাচ দিয়ে বসেন পারভেজ। শেষ হয় তাঁর ১৯ বলে ২১ রানের ইনিংসটি। লিটন না থাকায় তাওহিদ হৃদয়ের ওপর বড় দায়িত্ব ছিল মিডল অর্ডারে। কিন্তু তিনিও যতটা দ্রুত এসেছিলেন, ততটাই দ্রুত ফিরে যান ডাগআউটে। ১০ বলে ৭ রান করে যান তিনি অক্ষরকে বলে ক্যাচ তুলে। শামীম হোসেনও ফিরে যান শূন্য রানে, বরুণ চক্রবর্তীর বলে বোল্ড হয়ে। ঠিক এখান থেকেই যেন ব্যাকফুটে চলে যায় বাংলাদেশ। ৭৪ রানে চার উইকেট পড়ে যাওয়ার পর জাকের আলীর রানআউট। এক অধিনায়ককে আউট করেন আরেক অধিনায়ক সূর্যকুমার। তবে উইকেটে যাতায়াতে আসার পথে একজন চোয়াল চেপে লড়াই চালিয়ে যান, অক্ষরকে পরপর দুটি ছক্কা হাঁকিয়ে আশা বাঁচিয়ে রাখেন সাইফ। ৪০, ৬৫, ৬৬ আর ৬৭ রানে জীবন পাওয়ার পর অবশেষে ৬৯ রানে বুমরাহর বলে ক্যাচ দিয়ে আউট হন। সাইফ আউট হওয়ার পর হারের ১২৭ রানে অলআউট হয়ে যাওয়াটা ছিল শুধুই সময়ের অপেক্ষা।
অথচ ম্যাচের শুরুটা এদিন মন্দ ছিল না। টস জিতে ফিল্ডিং নিয়েছিলেন জাকের। নিজে অবশ্য ক্যাচ মিস করেছিলেন ৭ রানে থাকা ভারতীয় ওপেনার অভিষেক শর্মার। সেই অভিষেকই কিনা শেষ পর্যন্ত ৩৭ বলে ৭৫ করে যান। তানজিমের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন তিনি। বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েও তা গ্রিপে আনতে পারেননি জাকের। এখানেই লিটনের শূন্যতার প্রথম উপলব্ধি হয়। ব্রডকাস্ট ক্যামেরাও ডাগআউটে থাকা লিটনকে ফোকাস করে ঠিক তখন। বোলারের মুভমেন্টের আঁচ করতে পেরে উইকেটের পেছনে তাঁর যে নড়াচড়া, সেটি জাকেরের মধ্যে ছিল না। ঠিক এর পরের ওভারেই খোলস থেকে বেরিয়ে আসেন শুভমান গিল আর অভিষেক। নাসুমের ওই ওভারটিতে দুজনেই দুটি ছক্কা মারেন; ২১ রান কেড়ে নেন অনায়াসে। প্রথম তিন ওভারে স্কোর যেখানে ছিল ১৭, সেখানে পাওয়ার প্লের ষষ্ঠ ওভার শেষ হয় ৭২ রানে। অর্থাৎ, শেষ ১৮টি বলে আসে ৫৫ রান। দশম ওভারে ১০০ স্পর্শ করতে পারেনি; দুই উইকেটে ৯৬ রানে ভারতের ইনিংস। রানের গতি থমকে শেষ চারটি ওভারে আসে ২৪ রান।
তবে এই অভিষেককে থামানো হয়েছিল রানআউটে। এখানেও বিতর্ক ছুঁতে ছুঁতে তা এড়ানো গেছে। মুস্তাফিজকে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ঠেলে দিয়ে সিঙ্গেলস নিতে চেয়েছিলেন সূর্যকুমার। তবে রিশাদ সেখানে দারুণ ফিল্ডিংয়ে বলটি ঠেকিয়ে দেন। নন-স্ট্রাইক জোনে মুস্তাফিজের দিকে থ্রো করেন। বলটি ঠিকভাবে গ্রিপ করতে না পারলেও স্টাম্প ভেঙে দেন। লঙ্কান টিভি আম্পায়ার রবীন্দ্র ভিমালাশ্রী বারবার দেখে নিশ্চিত হয়েছিলেন, মুস্তাফিজের যে হাতে বল ছিল, সেই হাত দিয়েই তিনি স্টাম্প ভেঙেছেন। ৩৭ বলে ৭৫ রান করা অভিষেক ফিরে যান জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখানো সিদ্ধান্তটি নিয়ে। এরপর অবশ্য আফগান ফিল্ড আম্পায়ার আহমেদ শাহ পাকতিন সূর্যকুমারের নিশ্চিত আউটটি দেননি। রিভিউ চেয়ে তা নিয়ে নিতে হয় মুস্তাফিজকে। এটি ছিল এই ফরম্যাটে মুস্তাফিজের ক্যারিয়ারের ১৫০তম উইকেট। পরপর দুটি উইকেট শিকারের পর দুই পাশ থেকে চেপে ধরেন মুস্তাফিজ-নাসুম। সেখানে তানজিম এসে তাঁর আগ্রাসী ভঙ্গিতে তুলে নেন তিলক ভার্মার উইকেটটি। কিছুটা স্লোয়ারে দিয়ে তিলককে মিড উইকেটে সাইফ তালুবন্দি করেন।
শেষ তিনটি ওভারে হার্দিক পান্ডিয়াদের আটকে রাখার চ্যালেঞ্জ ছিল। সেখানে মুস্তাফিজ এসেছিলেন ১৭তম ওভারটিতে। পরের ওভারে তানজিম। ডেথ ওভারে কিছুটা নার্ভাস মনে হচ্ছিল তানজিমকে। নো বলসহ ওই ওভারটিতে ১৪ রান খরচ করে বসেন। পরের ওভারেই অবশ্য মুস্তাফিজ ৯ রান দিয়ে তাঁর কোটা শেষ করেন। আর সাইফউদ্দিন চমক দেখান তাঁর শেষ ওভারটিতে মাত্র ৪ রান দিয়ে। দুবাইয়ের পিচে এই ১৬৮ রানের পুঁজি যে সন্তুষ্টির নয়, সেটি ডাগআউটে বসা সূর্যকুমারের চোখমুখের অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছিল। তবে তাদের স্পিনাররা ম্যাচ শেষে অধিনায়কের মুখে হাসি ফিরিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ৬ উইকেট শিকার করেছিলেন তাদের স্পিনাররা। ১.৩৫ রান রেট নিয়ে সুপার ফোরের টেবিলে শীর্ষে তারা। আজ বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচের পর তাদেরও ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। সেখানে ফের সুযোগ মিলতে পারে আরও একটি বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের।