বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় নাটকটাই বোধহয় হয়েছে ২০২৩ বিশ্বকাপের আগে। অধিনায়ক তামিম ইকবালের হঠাৎ সরে দাঁড়ানো এবং অবসর। পরে সাকিব আল হাসানকে নেতৃত্বভার বুঝিয়ে দেয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।
প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে এরপর অবসর ভেঙে ফিরেছিলেন তামিম। কিন্তু বিশ্বকাপ খেলা হয়নি। চোট ছিল বলে তিনি সব ম্যাচ খেলতে পারতেন না, এমন কথা রটেছিল। এর মধ্যে তামিমকে বলা হয়েছিল, বিশ্বকাপে চার নম্বর পজিশনে খেলতে। রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে তামিম বিশ্বকাপ দল থেকেই সরে দাঁড়ান।
সাকিব-তামিমের দ্বন্দ্বে অনেক ঘটনাই ঘটেছে ওই বিশ্বকাপের আগে-পরে। যার সুরাহা এখনও হয়নি। তামিম সেই সময়টার কথা এখনও ভুলতে পারেননি।
প্রায় এক বছর ধরে জাতীয় দলের বাইরে থাকা তামিম এখন ধারাভাষ্যকার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। ভারত সফরে মাইক্রোফোন হাতে দায়িত্ব পালন করছেন সাবেক এই অধিনায়ক। সেখানেই 'স্পোর্টস্টার'র সঙ্গে দিয়েছেন বিশদ এক সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারে সাকিবের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন তামিম।
জাতীয় দলের হয়ে সবশেষ খেলেছেন ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে। গত একটি বছর কেমন কেটেছে তামিমের? এমন প্রশ্নে মনের কষ্ট উগড়ে দেন দেশের সর্বকালের সেরা ওপেনার।
তামিম বলেন, ‘সত্যি বলতে, এটা বেশ একটা যাত্রা হয়েছে। কখনো ভাবিনি বাংলাদেশের হয়ে খেলব না। তখন আমার লক্ষ্য ছিল, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলা এবং তারপর ক্যারিয়ার নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। কিন্তু তারপরে, অনেক অপ্রত্যাশিত জিনিস ঘটেছে এবং সেগুলো সুখকরও ছিল না।’
‘আপনার কারও সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক বা মতপার্থক্য থাকতেই পারে, কিন্তু যখন জাতীয় দলের ব্যাপার আসে, তখন সবার এক হওয়া উচিত। এখানে প্রতিশোধপরায়নতার কোনো সুযোগ নেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এটা ভাবা হয়নি।’
‘আমি খুবই আবেগী মানুষ, আমার সঙ্গে তখন যা হয়েছে সেটা মেনে নেওয়া সহজ ছিল না। যার জন্য আমি সরে দাঁড়াতে বাধ্য হই। অনেকেই মনে করে, আমার অবসরের সিদ্ধান্ত ছিল আবেগী, হুট করে। আসলে তা নয়। ঘোষণা দেওয়ার তিনদিন আগে আমি পরিবারের সঙ্গে কথা বলি, অবশ্যই কোনো কারণ ছিল বলেই, তাই না?’
তামিম যোগ করেন, ‘আমি বাংলাদেশের হয়ে ১৭ বছর খেলেছি, আমার সঙ্গে যা হয়েছে কখনই এমন কিছু দেখিনি। ওই অভিজ্ঞতার কারণেই আমাকে অবসর ঘোষণা করতে হয়েছিল।’
ওই সময়টা আপনি কীভাবে অতিক্রম করেছেন? তামিমের উত্তর, ‘চিন্তা করুন, আমি বাংলাদেশের অধিনায়ক এবং সফলও। আমি ব্যাট হাতেও পারফর্ম করছিলাম। মনে হচ্ছিল, সব কিছু আমার মতো করেই হচ্ছে। তাহলে আমি কেন হঠাৎ অবসর নেব? কী ঘটেছিল?’
‘আমি অধিনায়ক ছিলাম এবং পরিসংখ্যানের দিক থেকে সম্ভবত আমি বাংলাদেশের ইতিহাসেরই একজন সফল ওয়ানডে অধিনায়ক। সবকিছু এমনই সুন্দর ছিল। তাহলে কেন আমি সরে গেলাম? নিশ্চয়ই এমন কিছু হয়েছিল, যা আমি মানতে পারিনি, কেউ এমন পরিস্থিতি করেছিল যার জন্য আমার এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।’
আসলে কী ঘটেছিল? জানতে চাইলে হেসে দেন তামিম। বলেন, ‘অনেক কিছুই ঘটেছে। একের অধিক লোক এটাতে জড়িত ছিল। তারা খুব চতুরতার সঙ্গে কাজটা করেছে। সঙ্গত কারণেই আমি তাদের নাম বলব না। এই সময়ে এসে আমি কাউকে দোষ দিতে চাই না, কখনও দেবও না। তারা জানে তারা আমার সঙ্গে কী করেছে, আমিও। তাই এটা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। আমি বিশ্বাস করি, কর্মফল বলে একটা কথা আছে। কারও খারাপ চাইতে হয় না, কারণ এক সময় সেটা আপনার দিকেই ফিরে আসবে।’
সাকিবের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। সাকিব সম্প্রতি অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। তার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তামিম বলেন, ‘সম্পর্কের ওঠানামা আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আপনি যেন কারও ক্ষতি না করেন। আমরা দুজনই দেশের হয়ে খেলছি। আমি কখনই কারও নাম নিয়ে মিডিয়া বা লোকসম্মুখে কিছু বলিনি। তবে আমি বিশ্বাস করি, সাকিব বাংলাদেশের জন্য যা করেছে সত্যিই অসাধারণ। আপনি এটা অস্বীকার করতে পারবেন না, আপনার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকুক কিংবা না থাকুক। সে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার।’
আপনি কি মনে করেন, সাকিবের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক তিক্ত না হলে বাংলাদেশের ক্রিকেট আরও কিছু অর্জন করতে পারতো? তামিমের সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। কোনো সন্দেহ নেই। আমি বিশ্বাস করি, যদি আমাদের সম্পর্ক আরও দীর্ঘায়িত হতো, তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য সেটা গেম চেঞ্জার হতো। আমরা দুজনই দেশের জন্য ভালো কিছু করেছি। আমি ভাবতে পছন্দ করি যে, আমাদের দুজনেরই ইতিবাচক মানসিকতা এবং আমরা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য সেরাটা চাই।’
গত বছরের ওই ঘটনার পর আপনি কি কখনও সাকিব এবং বিসিবির সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান করার কথা ভেবেছিলেন? তামিমের উত্তর, ‘খুব কম মানুষই জানে, আসলে কী ঘটেছিল। আমি কিংবা তারা কেউই মিডিয়ায় এটা নিয়ে বলেনি, যা ঘটেছে আমি এখনও ভুলতে পারিনি। যদি এটা সমাধান করার দরকার পড়তো, তবে দুই পক্ষেরই পরিষ্কার এবং উদার মানসিকতা নিয়ে চেষ্টা করা দরকার ছিল।’