যুক্তরাষ্ট্র

ট্রাম্প প্রশাসন বাইডেন থেকে কতটা আলাদা হবে

ডেস্ক রিপোর্ট
  ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২৩:০৯
আপডেট  : ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২৩:১৩

‘যুক্তরাষ্ট্র যখন হাঁচি দেয়, বাকি বিশ্বের সর্দি লেগে যায়।’ বিশ্ববাণিজ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির প্রভাব বোঝাতে প্রায়ই এ কথা বলা হয়। শুধু বাণিজ্য নয়, বাকি বিশ্বের ওপর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রভাবও একই রকম।
যদিও বলা হয়, যে দলের সরকারই যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকুক, দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে খুব একটা বদল আসে না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প, তখন কোনো কিছু নিশ্চিত হয়ে বলা কঠিন।
নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ট্রাম্প। তিনি শুধু বড় জয়ই পাননি, বরং ২০১৬ সালের তুলনায় এবার পপুলার ভোট (সাধারণ ভোট) বেশি পেয়েছেন।

 

বাইডেন প্রশাসনের দ্বিচারিতায় ক্ষুব্ধ যুক্তরাষ্ট্রের আরব ও মুসলিম ভোটাররা ট্রাম্পের ভেতর আশার আলো খুঁজেছেন। তাঁদের বিশ্বাস, ট্রাম্প ক্ষমতায় গেলে গাজা যুদ্ধ বন্ধ হবে। ট্রাম্প নিজেও নির্বাচনী প্রচারণায় এমন প্রতিশ্রুতিই দিয়েছেন। ২০১৬ সালের তুলনায় তাই তো ট্রাম্প এবার আরব ও মুসলিম ভোট বেশি পেয়েছেন।

 

ট্রাম্প তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির পক্ষে প্রচার চালিয়ে ভোটারদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারে তিনি তাঁর পূর্বসূরি জো বাইডেনের নেওয়া বেশ কিছু সিদ্ধান্তকে ‘চরম ভুল’ হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন এবং তিনি হোয়াইট হাউসে ফিরলে পরিস্থিতি পাল্টে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি আসলে পরিস্থিতি কতটা পাল্টাতে পারবেন, নাকি অত্যাচারীদের অবস্থানই কেবল আরও শক্তিশালী হবে, তা আগামী দিনগুলোতে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তবে মোটাদাগে কয়েকটি ইস্যুতে কতটা বদল আসতে পারে, তা দেখে নেওয়া যাক।

মধ্যপ্রাচ্য-ফিলিস্তিনে কী হবে
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি খুব সম্ভবত বাইডেন প্রশাসনের মতোই থাকবে। যদিও এবার ট্রাম্পের জয়ে আরব ও মুসলিম ভোটারদের বড় ভূমিকা ছিল। গাজাযুদ্ধে দ্বিমুখী আচরণ করেছেন বাইডেন। একদিকে তিনি গাজায় চরম মানবিক বিপর্যয়ে থাকা ফিলিস্তিনিদের জন্য ত্রাণ পাঠানোর কথা বলেছেন। অন্যদিকে তিনিই আবার দুই হাতে ইসরায়েলের জন্য অস্ত্র পাঠিয়েছেন। ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র সংগঠন হামাসকে ধ্বংস করতে গিয়ে এক বছরের যুদ্ধে গাজাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরায়েলি সেনারা।

গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরু হয়। তার পর থেকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চারটি প্রস্তাব উঠেছে, যার সব কটিতেই ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ গত বুধবার এক যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বাকি ১৪ সদস্য যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানোর পক্ষে ভোট দিয়েছিল।

বাইডেন ও ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য দেখা যেতে পারে দেশটির অভিবাসন নীতি প্রশ্নে। বাইডেন ও তাঁর প্রশাসন অভিবাসীদের বিষয়ে নমনীয় ছিলেন।

বাইডেন প্রশাসনের দ্বিচারিতায় ক্ষুব্ধ যুক্তরাষ্ট্রের আরব ও মুসলিম ভোটাররা ট্রাম্পের সময়ে আশার আলো খুঁজেছেন। তাঁদের বিশ্বাস, ট্রাম্প ক্ষমতায় গেলে গাজা যুদ্ধ বন্ধ হবে। ট্রাম্প নিজেও নির্বাচনী প্রচারে এমন প্রতিশ্রুতিই দিয়েছেন। তাই তো ২০১৬ সালের তুলনায় ট্রাম্প এবার আরব ও মুসলিম ভোট বেশি পেয়েছেন।
ট্রাম্প কী আসলেই মধ্যপ্রাচ্যের জন্য শান্তির বার্তা নিয়ে আসবেন। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ দেখলে এমনটা কল্পনা করা বেশ কঠিন। মধ্যপ্রাচ্যকে শান্ত রাখতে ট্রাম্প ইরানকে প্রচণ্ড চাপে রাখার কৌশলে বিশ্বাসী। বাইডেনের জায়গায় তিনি হোয়াইট হাউসে থাকলে ‘ইরানের ওপর এতটাই চাপ প্রয়োগ করতেন যে হামাস ইসরায়েলে হামলাই করত না’। ফিলিস্তিনিদের নিয়ে তাঁর খুব একটা মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে ফিলিস্তিনিদের দাবি পুরোপুরি উপেক্ষা করে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নিয়েছিলেন। ট্রাম্পকে ‘হোয়াইট হাউসে থাকা ইসরায়েলের সবচেয়ে ভালো বন্ধু’ মনে করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
ওই অঞ্চলে ইসরায়েলের স্বার্থবিরোধী কোনো পদক্ষেপ ট্রাম্প যে নেবেন না, তা প্রায় বলেই দেওয়া যায়। বরং বাইডেন যেমন অন্ধের মতো ইসরায়েলকে সমর্থন করে গেছেন, ট্রাম্পও হয়তো তা–ই করবেন।

ইউক্রেনের ভাগ্যে কী
ট্রাম্প বলেছেন, তিনি এক দিনের মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে পারবেন। যুক্তরাষ্ট্রের হবু প্রেসিডেন্টের এ দাবি অবিশ্বাস্য শোনালেও তিনি হয়তো ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে সক্ষম হবেন।
ইউক্রেন এই যুদ্ধে রাশিয়ার কাছে হেরে যেতে শুরু করেছে। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিস এ–সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের সেনাদের গড় বয়স এখন ৪০। তাঁরা আর কত দিনে যুদ্ধের ধকল টেনে নিয়ে যেতে পারবেন, তা নিয়ে কথা হচ্ছে। তার ওপর রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত মার্কিন কংগ্রেস এ যুদ্ধের অর্থ জোগাতে কিয়েভকে আর কোটি কোটি ডলারের তহবিল ও অস্ত্রের জোগান দেবে না বলেই মনে হচ্ছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু 
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুফাইল ছবি: রয়টার্স
অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন উত্তর কোরিয়ার সেনাদের ইউক্রেনে যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যান্য দেশ থেকেও রুশ নাগরিকত্ব দেওয়াসহ মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার কথা বলে ভাড়াটে সেনা জোগাড় করে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছেন, এমন অভিযোগও আছে। দেশবাসীর চরম আপত্তির কারণে তিনি দেশ থেকে সেনা সংগ্রহ বন্ধ রেখেছেন।
এ অবস্থায় পুতিনও হয়তো এ যুদ্ধ আর টেনে নিয়ে যেত চাইছেন না। তাই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে একটি চুক্তি খুবই সম্ভব। তবে অবশ্যই সেই চুক্তি হবে রাশিয়ার পক্ষে।
২০১৪ সালের যুদ্ধে দখল করা ক্রিমিয়া রাশিয়া নিজেদের দখলেই রেখে দেবে। বড়জোর পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার দখল করা কিছু ভূখণ্ড কিয়েভ ফেরত পেতে পারে। বিনিময়ে ইউক্রেন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাবে না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিয়েভকে জাপানের মতো নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে। এ যুদ্ধে উভয় দেশ মিলে প্রায় ১০ লাখ মানুষ হতাহত হয়েছেন।

ন্যাটো নিয়ে সিদ্ধান্ত
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘একজনের জন্য সবাই এবং সবার জন্য একজন’ স্লোগানে ন্যাটো সামরিক জোট গঠিত হয়।
ন্যাটোর বর্তমান সদস্যসংখ্যা ৩২। ন্যাটো জোটের কার্যকারিতা নিয়ে ট্রাম্প প্রথম থেকেই সংশয়বাদী। ট্রাম্পের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ইউরোপ বিনা খরচে তার সুবিধা নিচ্ছে। ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ইচ্ছার কথাও বলেছিলেন। যদি এবার তিনি সেটা করে ফেলেন, তবে তা প্রায় এক শতাব্দী ধরে চলা ট্রান্স-আটলান্টিক প্রতিরক্ষা সম্পর্কের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প কী এটা করবেন? তাঁর হাতে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আছে কি? এ বছরের শুরুতে মার্কিন কংগ্রেস দেশটির কোনো প্রেসিডেন্টের একা এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আরও সীমিত করেছে। বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রকে ন্যাটো থেকে প্রত্যাহার করতে হলে কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে এই সিদ্ধান্তের পক্ষে বড় আকারে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হবে অথবা এমন একটি আইন পাস হতে হবে, যাতে পুরো কংগ্রেসের সমর্থন থাকবে।

চীনা পণ্যে শুল্কারোপ
ট্রাম্প ও বাইডেন উভয়ই চীনের তৈরি পণ্যের ওপর শুল্কারোপ করছেন। বাইডেন ভবিষ্যতে চীনের তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর ১০০ শতাংশ শুল্কারোপ করতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে চীনের তৈরি সব পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ এবং বাকি বিশ্ব থেকে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্কারোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। জানুয়ারিতে শপথ গ্রহণের পর তিনি কী করেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

জলবায়ু পরিবর্তন
প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মাথায় প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন ট্রাম্প। সেবার তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হয় বলে তাঁর জানা নেই। জলবায়ু আবার পরিবর্তন হয়ে আগের মতো হয়ে যাবে। জলবায়ু বিষয়ে নিজের দ্বিতীয় মেয়াদে তাঁর নীতিতে খুব একটা পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না।
বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়া পর যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফিরিয়ে এনেছিলেন।
এমন আরও নানা বিষয়ে বাইডেন প্রশাসন থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে নীতি নির্ধারণে পার্থক্য আসতে পারে। তবে বিশ্বের দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তনে ট্রাম্প সত্যিই আশার আলো হতে পারবেন কি না, তা নিয়ে জোর সংশয় রয়েছে।

তথ্যসূত্র: সিএনএন, আল জাজিরা, রয়টার্স