হস্তান্তরের দুই যুগ পর কেন পানামা খাল ফেরত চাইছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮:৩৯

পানামা খাল আবার যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর অভিযোগ, মার্কিন জাহাজের সঙ্গে ‘অন্যায্য’ আচরণ করা হচ্ছে। এ খাল ঘিরে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়েও ইঙ্গিত করেছেন ট্রাম্প।
এসব বিষয়কে যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থের জন্য একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা হিসেবে দেখছে। তবে ট্রাম্পের অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে পানামা সরকার।
আসুন, প্রশান্ত মহাসাগর আর আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী পানামা খাল সম্পর্কে একনজরে পাঁচটি বিষয় জেনে নেওয়া যাক_
১৯৭৭ সালে পানামার জাতীয়তাবাদী নেতা ওমর তোরিজোস ও তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বেশকিছু চুক্তিতে সই করেন। চুক্তির শর্ত মেনে ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পানামার কাছে এ খাল আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়।
পানামার নিয়ন্ত্রণ
পানামা খালের দৈর্ঘ্য ৮০ কিলোমিটার বা প্রায় ৫০ মাইল। এটি পরিচালনা করে পানামা খাল কর্তৃপক্ষ, যা পানামার একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান।
মধ্য আমেরিকার দেশ পানামার সংবিধানে এ খালকে ‘পানামা জাতির অবিচ্ছেদ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা আছে। তবে এ-ও বলা আছে, পানামা খাল বিশ্বের ‘সব জাতির’ জাহাজ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
পানামা খাল সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র। খালটি দিয়ে পরিবহন করা ৭৪ শতাংশ পণ্যবাহী কার্গো দেশটির। এরপরই চীনের অবস্থান। দেশটির হিস্যা ২১ শতাংশ।
খালটির ওপর চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো শক্তির—কারোরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
পণ্যবাহী জাহাজের টোল নির্ধারণ করে পানামা সরকার। খালের প্রয়োজনীয়তা আর আন্তর্জাতিক চাহিদার ওপর নির্ভর করে টোলের তারতম্য হয়। এ ছাড়া জাহাজে কার্গো বহনের ধারণক্ষমতা টোল নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হুমকি নাকচ করে দিয়েছেন পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো। গত রোববার তিনি বলেন, ‘খালটির ওপর চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো শক্তিরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’
সব ধরনের নৌযান, এমনকি যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন এ খাল দিয়ে চলাচল করতে পারে।
জাতীয় ইতিহাস
সময়টা ১৯০৩ সাল, কলম্বিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে পানামা। এ ঘটনার সঙ্গেও পানামা খালের সম্পর্ক রয়েছে।
ফরাসিরা একটি খাল খননের উদ্যোগ নিলেও সফল হতে পারেনি। এরপর এগিয়ে আসে মার্কিনরা। দুই পক্ষের চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী, খাল খননের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিজেদের জমি ও জলসীমা ছেড়ে দেয় পানামা।
ঐতিহাসিক এ অর্জনের কোনো ধরনের উল্টোযাত্রা শুধু আমাদের সংগ্রামকেই অসম্মান জানাবে না; বরং এ অর্জনের সঙ্গে জড়িতদের স্মৃতির প্রতিও অপমান করা হবে।
মার্টিন তোরিজোস, পানামার সাবেক প্রেসিডেন্ট
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে সময় লাগে ১০ বছর। খরচ হয় ৩৮ কোটি ডলার। অবশেষে ১৯১৪ সালের ১৫ আগস্ট পানামা খাল আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। প্রথম একটি স্টিমার খালটি অতিক্রম করে।
পানামা খাল খননে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের প্রাণ যায়। খননকাজ চলার সময় বিভিন্ন রোগ ও দুর্ঘটনায় তাঁদের মৃত্যু হয়।
পানামার প্রেসিডেন্ট রাউল মুলিনো বলেন, ‘এ খাল আমাদের “ইতিহাসের অংশ” ও একটি “অপরিবর্তনীয় অর্জন”।’
যুক্তরাষ্ট্রের ছিটমহল
আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পর দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল পানামা খাল। শুধু তাই নয়, সেখানে একটি বিশেষায়িত ‘ক্যানাল জোন’ বা ছিটমহলের মতো খাল অঞ্চল গড়ে তুলেছিল ওয়াশিংটন। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব সামরিক ঘাঁটি, পুলিশ, এমনকি বিচারব্যবস্থা কার্যকর ছিল।
পানামার মানুষের মধ্যে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা আর পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা দীর্ঘদিন ধরে ছিল। বিভিন্ন সময় এই দাবি উঠে এসেছে।
অবশেষে এ দাবি আলোর মুখ দেখে ১৯৭৭ সালে। পানামার জাতীয়তাবাদী নেতা ওমর তোরিজোস ও তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বেশকিছু চুক্তিতে সই করেন। চুক্তির শর্ত মেনে ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পানামার কাছে এ খাল আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়।
পানামা খালকে ‘নিরপেক্ষ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ খাল দিয়ে যেকোনো নৌযানের চলাচলের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। তবে শর্ত হলো চলাচলকারী নৌযানগুলোকে খালের নিরাপত্তা–সংশ্লিষ্ট বিধান মেনে চলতে হবে। আর যুদ্ধরত দেশগুলোর সামরিক নৌযান একই সময়ে একসঙ্গে খাল পার হতে পারবে না।
ওমর তোরিজোসের ছেলে ও পানামার সাবেক প্রেসিডেন্ট মার্টিন তোরিজোস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘ঐতিহাসিক এ অর্জনের কোনো ধরনের উল্টোযাত্রা শুধু আমাদের সংগ্রামকেই অসম্মান জানাবে না, বরং এ অর্জনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের স্মৃতির প্রতিও অপমান করা হবে।’
চুক্তিগুলোয় ৪০টির বেশি দেশ সমর্থন দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পানামা খালকে ‘নিরপেক্ষ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এ খাল দিয়ে যেকোনো নৌযান চলাচলের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। তবে একটা শর্ত রয়েছে। তা হলো নৌযানগুলোকে খালের নিরাপত্তা–সংশ্লিষ্ট বিধান মেনে চলতে হবে। আর যুদ্ধরত দেশগুলোর সামরিক নৌযান একই সময়ে একসঙ্গে খাল পার হতে পারবে না।
ব্যবস্থাপনা
পানামা খালের ব্যবস্থাপনা মিসরের সুয়েজ খালের মতো নয়। পানামা খাল দুটি জলাধারে সঞ্চিত মিঠাপানি ব্যবহার করে সক্রিয় রাখা হয়।
খরায় পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ২০২৩ সালে পানামা খাল দিয়ে নৌযান চলাচলের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছিল। যদিও পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
এ খাল দিয়ে নৌযান চলাচলের সংখ্যা বাড়ানো-কমানোর পূর্বনির্ধারিত ব্যবস্থা আছে। এ ব্যবস্থা বিশ্ববাণিজ্যে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলে প্রভাব ফেলে।
পানামা খাল না থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজগুলোকে দক্ষিণ আমেরিকার কেইপ হর্ন হয়ে চলাচল করতে হতো। পানামা খাল নিউইয়র্ক থেকে সানফ্রান্সিকো অভিমুখী জাহাজগুলোর ২০ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দূরত্ব ছেঁটে ফেলেছে।