চার বছর আগে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি, সারা বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছিল কীভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা মার্কিন ক্যাপিটলে হামলা চালিয়েছিল। যা নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেওয়ার একটি চেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। সেই দিনটি আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্য একটি অন্ধকার দিন হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে সেই একই ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসছেন। তার এই ফিরে আসা আমেরিকার রাজনীতিতে একটি বিশাল পরিবর্তনের সূচনা করেছে। যা শুধু দেশীয় নয় বরং বৈশ্বিক রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে চলেছে।
ট্রাম্পের ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় শুধুমাত্র তার নিজের রাজনৈতিক দক্ষতাই নয় বরং আমেরিকার সমাজে গভীর বিভক্তিরও প্রতিফলন। তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির মাধ্যমে বিশ্বমঞ্চে ফেরার প্রস্তুতি এবং দেশীয় ইস্যুগুলোতে নজর দেওয়া আমেরিকার ভবিষ্যতের জন্য নতুন সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
২০২৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল: এক ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন
২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী ও বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে হারিয়ে একটি ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন করেছেন। পেনসিলভানিয়া, মিশিগান, উইসকনসিন, জর্জিয়া এবং অ্যারিজোনা—এসব গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে জয় লাভ করেন ট্রাম্প, যেগুলো ২০২০ সালে বাইডেনের পক্ষে ছিল। এবার ট্রাম্প শুধু ইলেকটোরাল কলেজেই জয় পাননি বরং জনপ্রিয় ভোটেও জয়ী হয়েছেন। যা ২০১৬ সালে তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
তার নির্বাচনী প্রচারণার মূল বিষয় ছিল অর্থনীতি, অভিবাসন, এবং মুদ্রাস্ফীতির মতো জনগণের তাৎক্ষণিক উদ্বেগগুলির সমাধান। “মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন, এগেইন” স্লোগানটি অনেক আমেরিকানের মধ্যে একটি নতুন আশা জাগিয়ে তোলে। অন্যদিকে, বাইডেন প্রশাসনের দুর্বল পারফরম্যান্স এবং ডেমোক্র্যাট পার্টির অভ্যন্তরীণ বিভাজন ভোটারদের মনোযোগ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। তরুণ প্রজন্মের প্রগতিশীলরা আরও র্যাডিক্যাল নীতিমালার পক্ষে থাকলেও দলটির কেন্দ্রীয় অংশ অতিমাত্রায় মধ্যপন্থী ছিল, যা বাইডেনের নির্বাচনী প্রচারণাকে দুর্বল করে তোলে।
৬ জানুয়ারি এবং ট্রাম্পের রাজনৈতিক স্থায়িত্ব
ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক জীবন এক বিস্ময়কর অধ্যায়। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল হামলার ঘটনায় তিনি দ্বিতীয়বার অভিশংসিত হয়েছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহের উসকানি’ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। অনেক বিশ্লেষক ধারণা করেছিলেন, এটাই ট্রাম্পের রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি।
কিন্তু ট্রাম্প এই ঘটনার পর তার সমর্থকদের কাছে নিজেকে ‘রাজনৈতিক শিকার’ হিসেবে তুলে ধরেন। তার সমর্থকরা এই ঘটনার একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা গ্রহণ করে। তারা এটিকে ‘ভোট জালিয়াতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ’ হিসেবে দেখে। এমনকি তার ২০২৪ সালের প্রচারণায় ৬ জানুয়ারির ঘটনার স্লোগান এবং চিত্র ব্যবহার করা হয়। যা তার মূল সমর্থকদের আরও শক্তিশালীভাবে একত্রিত করে।
বাইডেন প্রশাসনের চ্যালেঞ্জ
জো বাইডেনের চার বছরের মেয়াদ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ ছিল। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন বিতরণ এবং আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন সফলভাবে করতে পারলেও, বাইডেন প্রশাসন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়।
মুদ্রাস্ফীতি রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এছাড়া, দক্ষিণ সীমান্তে অভিবাসন সংকট, আফগানিস্তান থেকে বিশৃঙ্খল প্রত্যাহার এবং চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে উত্তেজনার মতো বৈদেশিক নীতির ভুল পদক্ষেপ বাইডেনের জনপ্রিয়তাকে আরও কমিয়ে দেয়।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের বৈশ্বিক প্রভাব
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ আমেরিকার বৈদেশিক নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে চলেছে। তার "আমেরিকা ফার্স্ট" নীতির পুনরুত্থান বিশ্বব্যাপী একটি অস্থির পরিবেশ তৈরি করতে পারে।
ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্য এবং মেধাস্বত্ব চুরির বিষয়টি আরও কড়া নীতিতে মোকাবিলা করার সংকেত দিয়েছেন। তবে রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি ট্রাম্পের প্রশংসা ন্যাটোর ঐক্যকে দুর্বল করতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের অগ্রাধিকার থাকবে জ্বালানি খাতকে শক্তিশালী করা এবং সৌদি আরব ও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করা। জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের মতো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত তার দ্বিতীয় মেয়াদেও আরও বড় পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ইউরোপ ও অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে বাণিজ্যিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে পারে। তার প্রোটেকশনিস্ট নীতিগুলি বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল এবং বিনিয়োগের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
ট্রাম্পের জলবায়ু পরিবর্তন সংশয়বাদ আন্তর্জাতিক জলবায়ু উদ্যোগে আরও পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তার প্রশাসনের নীতিমালা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
গণতন্ত্রের জন্য শিক্ষা
ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফিরে আসা গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এটি দেখিয়েছে যে জনগণের উদ্বেগকে সমাধান করতে না পারলে নির্বাচনের ফলাফল কতটা পরিবর্তিত হতে পারে।
ডেমোক্র্যাট পার্টির জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা। শুধু ‘গণতন্ত্র রক্ষা’ বা ‘চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই’ করার কথা বললে হবে না। জনগণের অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার মতো বাস্তব সমস্যাগুলোতে মনোযোগ দিতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুধুমাত্র আমেরিকার নয়, বরং সারা বিশ্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হতে চলেছে। তার নেতৃত্বে আমেরিকার ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে উত্তেজনা ও উদ্বেগ উভয়ই রয়েছে।
বাইডেন ক্ষমতায় থাকাকালে বিশ্বজুড়ে চলমান দাঙ্গা এক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। তবে, ট্রাম্প বারবার এসব যুদ্ধ বন্ধের আশ্বাস দিয়ে আসছেন। আর তার এই আশ্বাস কতটা বাস্তবিক হবে সেই ভবনা বিশ্ববাসীর। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে আগামী চার বছর আমেরিকার এবং বৈশ্বিক রাজনীতির দিক নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে মনে করছেন বিশ্লৈষকরা।