ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন সুপ্রিম কোর্টে ‘এলিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট’ প্রয়োগ করতে শুক্রবার (২৮ মার্চ) আবেদন করেছেন, যাতে তাকে কোনো বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়াই অভিবাসীদের নির্বাসিত করার অনুমতি দেওয়া হয়। আবেদনে বলা হয়েছে, ‘প্রেসিডেন্টের জাতীয়তার ভিত্তিতে লোকজনকে অপসারণের চূড়ান্ত ক্ষমতা রয়েছে। এর আগে ১৫ মার্চ ফেডারেল আপিল আদালত, বিচারক জেমস বোসবার্গের জারি করা অস্থায়ী আদেশটি বহাল রাখে, যা নির্বাসন কার্যক্রম স্থগিত করেছিল। তবে, ট্রাম্প প্রশাসন ১৭৯৮ সালের ‘এলিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট’-এর ভিত্তিতে এই পদক্ষেপের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি নাগরিকদের আটক করার ন্যায্যতা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। বর্তমানে এটি কোর্টে আসা ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ সংক্রান্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মধ্যে একটি এবং হোয়াইট হাউস ও বিচার বিভাগের মধ্যে এটি তীব্র বিরোধের কেন্দ্রে রয়েছে।
এ নিয়ে আইনজীবী সারাহ হারিস সুপ্রিম কোর্টকে বলেন, ‘এই মামলাটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করে- এমন সংবেদনশীল জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত কে নেবে- রাষ্ট্রপতি (আর্টিকেল ২’-এর অধীনে) নাকি বিচার বিভাগ? সংবিধান একেবারে স্পষ্ট উত্তর দেয়- রাষ্ট্রপতি। প্রজাতন্ত্র অন্য কোনো বিকল্প সহ্য করতে পারে না।’
হারিস আরো লিখেছেন, ‘শুধু এই কোর্টই রুল-বাই-টিআরও (অস্থায়ী আদেশ) থেকে শক্তি-বিভাজনের এই প্রক্রিয়াকে থামাতে পারে- যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এখানে, ডিস্ট্রিক্ট আদালতের আদেশ রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে, যেভাবে তিনি জাতিকে বিদেশী সন্ত্রাসী সংগঠন ও সংবেদনশীল বিদেশি আলোচনা রক্ষার জন্য সুরক্ষিত করার কথা বলেছিলেন, যা দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।’
ট্রাম্প প্রশাসনের যুক্তি হলো, নিম্ন আদালতগুলি তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, অস্থায়ী আদেশ জারি করছে- যদিও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার উপর চ্যালেঞ্জগুলি সমাধান না করে তাঁর এজেন্ডার কিছু অংশকে সাময়িকভাবে থামিয়ে রেখেছে।
বিচার বিভাগ সুপ্রিম কোর্টের কাছে একটি অস্থায়ী প্রশাসনিক স্থগিতাদেশ চেয়েছিল, যা বিচারকদের মামলাটি পর্যালোচনা করার জন্য সময় দিয়ে বোসবার্গের আদেশ কয়েক দিনের জন্য স্থগিত রাখবে। এই ধরনের স্থগিতাদেশ, যদি মঞ্জুর করা হয়, তাহলে প্রশাসন অবিলম্বে নির্বাসন পুনরায় শুরু করতে পারবে।
মামলায় বিতর্কিত বিষয় হলো ‘এলিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট’ প্রেসিডেন্ডকে অননুমোদিত অভিবাসীদের লক্ষ্যবস্তু করার এবং অপসারণের জন্য ব্যাপক ক্ষমতা দেয়। যুদ্ধের সময় অথবা যখন কোনও শত্রু আক্রমণ বা শিকারী অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে, তখন আইনটি সেই কর্তৃত্ব দেয়। ট্রাম্প এই আইনটি প্রয়োগ করার পরপরই কর্মকর্তারা তিনটি বিমান ভরে ৪০০’-এরও বেশি ভেনেজুয়েলার নাগরিককে এল সালভাদরে নিয়ে যান, যেখানে তাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কারাগারে রাখা হচ্ছে।
বোসবার্গের প্রথম রায়ের সময় যখন দুইটি ফ্লাইট আকাশে ওড়ছিল, তখন তিনি আদেশ দিয়েছিলেন যে, অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনা হোক। কিন্তু তারা ফিরে আসেনি। সন্দেহভাজন ভেনেজুয়েলান গ্যাং ‘ট্রেন দি আরাগুয়ার’ সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে তাদের কোনো আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়াই এল সালভাদরে পাঠানো হয়। তাদের কিছু আত্মীয় ও বন্ধুরা দাবি করেছেন যে, তারা কোনো গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত নন এবং শুধুমাত্র ট্যাটুর কারণে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। যেমন- ২৪ বছর বয়সী এক ভেনেজুয়েলান যুবককে কেবলমাত্র অটিজম গ্রহণযোগ্যতা আন্দোলনের প্রতীকী ফিতা ট্যাটুর কারণে নির্বাসিত করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই নির্বাসন মানবাধিকার কর্মীদের দ্বারা ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছে।
এদিকে প্রশাসন বলেছে যে, ‘ঐসব লোকের মধ্যে কেউ কেউ ১৮শ শতকের আইন ব্যতিরেকে অন্য কর্তৃত্বের অধীনে নিষ্হাপিত হয়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করেছে, এই ব্যক্তিরা ভেনেজুয়েলার ‘ট্রেন দি আরাগুয়া’ নামক গ্যাংয়ের সাথে যুক্ত ছিল। প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস, ট্রাম্পের মামলার পরিচালনার জন্য বোসবার্গকে অভিশংসিত করার পরামর্শ দেওয়ার বিরল তিরস্কার করার কয়েক দিন পরেই মামলাটি হাইকোর্টে পৌঁছায়।
এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আটক পাঁচজন ভেনেজুয়েলান, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তারা আইনের ব্যবহারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মনোনীত বিচারক জেমস বোসবার্গ, মামলাটি চলাকালীন প্রশাসনকে এই আইনের আওতায় আর কাউকে নির্বাসন দেওয়া থেকে সাময়িকভাবে নিষেধ করেছেন। এর মধ্যে মামলাকারী পাঁচজন বা তাদের মতো অন্য কেউ। তবে, বোসবার্গের আদেশ প্রশাসনকে অন্য আইন অনুযায়ী ওই ব্যক্তিদের নির্বাসন দিতে বাধা দেয়নি এবং এটি এই আইনের অধীনে অভিবাসীদের আটক করাও বন্ধ করেনি।
গত বুধবার (২৬ মার্চ) ডিসি সার্কিট কোর্ট অফ আপিলস ২-১ ভোটে রায় দেয় যে, বোসবার্গের আদেশ ততক্ষণ কার্যকর থাকবে, যতক্ষণ না আইনি চ্যালেঞ্জের নিষ্পত্তি হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের মধ্যে ছিলেন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচডব্লিউ বুশ ও ওবামার মনোনীত দুই বিচারক। ট্রাম্প এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছেন।
আদালত ট্রাম্পের ‘এলিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট’ ব্যবহারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জকারীদের আগামী মঙ্গলবারের মধ্যে জরুরি আবেদনের জবাব দিতে বলেছে।
অন্যদিকে, অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি বৃহস্পতিবার ফক্স নিউজের লরা ইনগ্রাহামের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেন যে, ট্রাম্পের নির্বাসন আদেশ আটকানোর কোনো অধিকার বিচারকদের নেই এবং এই বিষয়টি শীঘ্রই সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছাবে। তিনি বলেন, ‘দেশজুড়ে এসব বিচারক... তারা মনে করেন যে তাদের ক্ষমতা আছে, কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কারণ, এই মামলাগুলো খুব দ্রুত সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছে; আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’
তবে মার্কিন সার্কিট বিচারক কারেন হেন্ডারসনের মতামত ও বিশ্লেষণটি আদালতের অনেক রক্ষণশীল বিচারকের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। তিনি ট্রাম্পের যুক্তিগুলো কঠোরভাবে খণ্ডন করেন, যেখানে বলা হয়েছিল যে আদালত এই আইনের প্রয়োগ পর্যালোচনা করতে পারে না এবং যে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে অভিবাসীদের প্রবাহকে ‘আক্রমণ’ হিসেবে গণ্য করা উচিত।
তিনি লেখেন, ‘আক্রমণ’ শব্দটি ১৭৯৮ সালে পঞ্চম কংগ্রেস এবং আমেরিকান জনগণের কাছে সুপরিচিত ছিল। এটি জনগণের দ্বারা অনুমোদিত সংবিধানের বিভিন্ন অংশে প্রতিধ্বনিত হয়েছে, যা মাত্র নয় বছর আগে কার্যকর হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে, এটি সামরিক অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।'
বিচারক বোসবার্গের জারি করা আদেশগুলো শনিবার শেষ হতে যাচ্ছে, যদি না তিনি আরও দুই সপ্তাহের জন্য তা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। যদি তিনি সময় বাড়ান, তবে সেই সময়ে তিনি শুনবেন যে, ট্রাম্পের ‘এলিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট’ ব্যবহারের বিষয়ে প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিত কিনা- যা এই আইনের প্রয়োগ নিয়ে বড় আইনি লড়াইকে আরও দ্রুত এগিয়ে নিতে সহায়ক হতে পারে।