যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে একটি বিল প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘অপশনাল প্র্যাকটিক্যাল ট্রেইনিং’ (ওপিটি) কর্মসুযোগ প্রোগ্রাম বাতিলের কথা বলা হয়েছে। এটি বাতিল হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে, ৩ লাখেরও বেশি ভারতীয় শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে।
দ্য ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই বিল পাস হলে ৩ লাখেরও বেশি ভারতীয় শিক্ষার্থী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
ওপিটি প্রোগ্রাম আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্ম-অনুমোদন ব্যবস্থা, যা স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পর যুক্তরাষ্ট্রে ১ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত কাজ করার সুযোগ দেয়। বিশেষ করে এসটিইএম বা স্টেম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত) ক্ষেত্রের শিক্ষার্থীরা এই সুবিধা পেয়ে থাকেন।
ভারতীয় শিক্ষার্থীদের উপর প্রভাব
ওপেন ডোরস ২০২৪ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে ওপিটি প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যা ছিল ৯৭ হাজার ৫৫৬, যা আগের বছরের তুলনায় ৪১ শতাংশ বেশি। এই বিল পাস হলে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্নাতক ডিগ্রি শেষ করেই ফিরে যেতে হতে পারে, যা তাদের ক্যারিয়ার ও আর্থিক স্থিতিশীলতার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। তাছাড়া অনেক শিক্ষার্থী উচ্চ সুদের শিক্ষাঋণ মেটানোর জন্য ওপিটির ওপর নির্ভরশীল।
এমন পরিস্থিতিতে ওপিটি বাতিল হলে ভারতীয় শিক্ষার্থীরা কানাডা, জার্মানি বা অস্ট্রেলিয়ার দিকে ঝুঁকবেন বলে মনে করা হচ্ছে। কানাডা এরই মধ্যে পোস্ট-স্টাডি ওয়ার্ক পারমিটের (পিজিডব্লিউপি) সুবিধা বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করছে।
এইচ-১বি ভিসা পেতে দৌড়ঝাঁপ
বর্তমান এফ-১ ও এম-১ ভিসাধারীরা এখন দ্রুত চাকরির জন্য আবেদন করছেন, যাতে ভবিষ্যতে এইচ-১বি ওয়ার্ক ভিসার জন্য বিবেচিত হতে পারেন। সাধারণত এই ভিসা বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে স্পনসর করা হয়। কিন্তু এই ভিসা পাওয়া অত্যন্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও প্রতিবছর সীমিতসংখ্যক ভিসা ইস্যু করা হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাকরি ও ভিসা পাওয়ার জন্য লড়ছেন।
ইমিগ্রেশন আইনজীবী ও লকুয়েস্টের প্রতিষ্ঠাতা পূর্বরি চোথানি বলেন, ওপিটি প্রোগ্রাম স্নাতকের পর শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি খোঁজার সুযোগ দেয়। স্টেমের শিক্ষার্থী হয়ে থাকলে এই সময় আরও দুই বছর বাড়ানো যায়, তবে সেটা নির্ভর করে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতার উপর। তিনি জানান, বিলটি পাস হলে এই গুরুত্বপূর্ণ সুযোগটি হারিয়ে যেতে পারে ও শিক্ষার্থীদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে।
এদিকে, অনেক ভারতীয় শিক্ষার্থী গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে ভ্রমণ পরিকল্পনা বাতিল করেছেন, কারণ তারা ভয় পাচ্ছেন দেশে ফিরে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে পুনরায় প্রবেশের অনুমতি নাও পেতে পারেন। কর্নেল, কলম্বিয়া ও ইয়েলের মতো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘অনানুষ্ঠানিকভাবে’ বিদেশি শিক্ষার্থীদের দেশে না ফেরার পরামর্শ দিয়েছে, যা উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলছে।
এই বিলটি যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের অভিবাসনবিরোধী নীতির অংশ বলে মনে করা হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, তিনি কঠোর ভিসা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাপক বহিষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর ফলে বর্তমানে দেশটিতে অবস্থানরত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও অভিবাসন প্রত্যাশীদের মধ্যে ব্যাপক অস্থিরতা বিরাজ করছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও মার্কিন অর্থনীতির ওপর প্রভাব
মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ওপিটি প্রোগ্রাম বাতিল হলে শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসার আগ্রহ হারাবেন, ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয় কমে যাবে।
এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ভারতীয় শিক্ষার্থীরাই বছরে মার্কিন অর্থনীতিতে ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলারের বেশি অবদান রাখেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলোও এই পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। তারা মনে করছেন, ট্রাম্পের এমন আচরণে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তির হার কমে যেতে পারে, যার ফলে আর্থিক ও বৈচিত্র্যজনিত ক্ষতি হবে।
২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা রেকর্ড ১১ লাখ ২৬ হাজার ৬৯০ এ পৌঁছেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৭ শতাংশ বেশি। স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮ শতাংশ বেড়ে ৫ লাখ ২ হাজার ২৯১ এ পৌঁছেছে।
আর স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ব্যবহারিক কাজের অভিজ্ঞতার প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কমিউনিটি কলেজগুলোতেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখা গেছে, যেখানে ভর্তির সংখ্যা ১৩ শতাংশ বেড়ে ৫৯ হাজার ৩১৫ এ পৌঁছেছে, যা গত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী বৃদ্ধির ঘটনা।
২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি এবং ৩ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করেছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব কমার্স।
সূত্র: এনডিটিভি