৫১তম রাজ্য হওয়ার কথা বলে ট্রাম্প আসলে কানাডার কাছ থেকে কী চান !

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ২৩:৪৪

উত্তর আমেরিকার মানচিত্রে ম্যাচিয়াস সিল দ্বীপ একটি ক্ষুদ্র বিন্দুমাত্র।তবে জনবসতিহীন, কুয়াশায় ঢাকা পাথুরে এই দ্বীপটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই দ্বীপটি ‘গ্রে জোন’ হিসেবে পরিচিত অঞ্চলে অবস্থিত। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিরল এক আন্তর্জাতিক বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে এই ছোট্ট দ্বীপ।
প্রতিবেশী ও দীর্ঘদিনের মিত্র এই দুই দেশই দীর্ঘদিন ধরে দ্বীপটি ও এর আশপাশের জলসীমার মালিকানা দাবি করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের মেইন অঙ্গরাজ্যের সঙ্গে কানাডার নিউ ব্রান্সউইক প্রদেশ এই জায়গায় এসে মিলে গেছে। দুই দেশই সেখানকার মূল্যবান গলদা চিংড়ি ধরা ও বিক্রির অধিকার চায়।
গলদা চিংড়ি ধরেন এমন একজন মার্কিন জেলে হচ্ছে জন ড্রাইউন। তিনি ৩০ বছর ধরে গ্রে জোনে মাছ শিকার করছেন। তিনি বলছিলেন, প্রতিবছর গ্রীষ্মের শুরুর দিকে চিংড়ি শিকারের মৌসুমে মার্কিন ও কানাডীয় জেলেদের মধ্যে কে আগে ফাঁদ বসাবে, তা নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। জন বলেন, এই করতে গিয়ে মানুষ শরীরের অঙ্গ হারিয়েছে, মাথায় আঘাত পেয়েছে, মাথা ফেটে গেছে—এমন সবকিছু হয়েছে।

এসব আঘাতের ঘটনা সাধারণত তখনই ঘটে, যখন এক জেলের জাল বা দড়িতে আরেকজন জেলে আটকে যায়। কানাডীয় এক জেলের দড়িতে আঙুল আটকে ড্রাইউনের এক বন্ধু আঙুল হারান। ড্রাইউন একে বলছেন তাঁর গ্রে জোন যুদ্ধের চিহ্ন।
১৭ শতকের শেষ দিক থেকে মাচিয়াস সিল দ্বীপ ঘিরে প্রায় ২৭৭ বর্গমাইল সমুদ্র এলাকা বিরোধপূর্ণ। ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক একটি আদালত দুই দেশকেই এই জলসীমায় মাছ ধরার অনুমতি দেন।
দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা এই বিরোধ কেবল একটি ব্যতিক্রম বলা যায়—দুই দেশের মধ্যে বিচ্ছিন্ন উত্তেজনার জায়গা। বাকি সব ক্ষেত্রে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ।
তবে দুই দেশের এই সম্পর্ক এখন বদলাতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফেরা, কানাডার পণ্যে বড় অঙ্কের পাল্টা শুল্ক আরোপ এবং কানাডাকে ৫১তম রাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার মতো বক্তব্য নতুন করে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। এত কিছুর মধ্যেও প্রশ্ন জাগে—ট্রাম্প আসলে কানাডার কাছ থেকে কী চান?

চিংড়ি নিয়ে যুদ্ধ
যুক্তরাষ্ট্রের কাটলার ও মেইন হচ্ছে ‘গ্রে জোনের’ সবচেয়ে কাছের শহর। এখানে কিছু বাড়ি, একটি দোকান ও চিংড়ির একটি পাইকারি বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে।
সাগরে থাকা চিংড়ির ওপর মূলত কাটলারের অস্তিত্ব নির্ভর করে। এখানকার জেলেরা প্রতিদিন গালফ অব মেইনের তলদেশে ফাঁদ পেতে মূল্যবান চিংড়ি ধরে বাজারে বিক্রি করেন।
চিংড়ির মৌসুমে এই জলসীমা নৌকা ও দড়ির চিহ্নে ভর্তি থাকে। জায়গা ও জীবিকার জন্য জেলেদের লড়াই চলতে থাকে এবং মাঝেমধ্যে সেটা খারাপ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়।
গলদা চিংড়ি ধরেন এমন একজন মার্কিন জেলে হচ্ছে জন ড্রাইউন। তিনি ৩০ বছর ধরে গ্রে জোনে মাছ শিকার করছেন। তিনি বলছিলেন,  প্রতিবছর গ্রীষ্মের শুরুর দিকে চিংড়ি শিকারের মৌসুমে মার্কিন ও কানাডীয় জেলেদের মধ্যে কে আগে ফাঁদ বসাবে, তা নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।
জন ড্রাইউন বলেন, ‘আমরা কি এই বিষয়টি পছন্দ করি?’ নিজেই জবাব দেন, একদমই না। তিনি বলেন, ‘যত দিন আমার নিশ্বাস থাকবে, তত দিন এ নিয়ে আমি অভিযোগ করে যাব।’
মেইনের আরেক জেলে নিক লেমিউ বলেন, গত কয়েক বছরে প্রায় ২০০ ফাঁদ চুরি হয়েছে। এসব ঘটনার জন্য তিনি কানাডিয়ান প্রতিদ্বন্দ্বীদের দায়ী করেন।
নিক লেমিউ বলেন, ‘এটি আমাদের এলাকা। এটিই আমাদের কাজ করার জায়গা। এমন ব্যাপার আমাদের ভালো লাগে না।’
মার্কিন জেলেদের অভিযোগ করেন, বড় চিংড়ি কীভাবে ধরা যায়, সেই নিয়ম তৈরি করে কানাডীয়রা কাজ করছে।
কানাডীয় জেলেরাও পাল্টা অভিযোগ করেন, মার্কিন জেলেরা তাদের জলসীমা অতিক্রম করে গোপনে কানাডার জলসীমায় ঢুকে পড়ছেন।
কানাডার সীমান্ত কর্মকর্তাদের প্রতিনিধিত্ব করে এমন একটি ইউনিয়ন অভিযোগ করেছে, তাদের রীতিনীতির প্রয়োগের চেষ্টার জবাবে মার্কিনরা সহিংসতার হুমকি দিয়েছে। এ কারণে কানাডার কিছু কর্মকর্তা ‘গ্রে জোনে’ কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
কানাডা মাচিয়াস সিল দ্বীপে থাকা স্বয়ংক্রিয় বাতিঘরের দেখাশোনা করতে সেখানে নিয়মিতভাবে রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীদের পাঠায়। কানাডা বলছে, দ্বীপ যে তাদের নিয়ন্ত্রণের, এটিই তার প্রমাণ। অন্যদিকে, মার্কিনরা যুক্তি দিচ্ছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউএস মেরিন দ্বীপটি দখলে রেখেছিল। সেটাই হচ্ছে তাদের সার্বভৌমত্বের প্রমাণ।

সীমান্ত বিরোধ
এই বিরোধ কোথাও প্রভাব ফেলছে বলে মনে হচ্ছে না। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ‘গ্রে জোনে’ ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দুই দেশের সামগ্রিক উষ্ণ সম্পর্কের ওপর তেমন প্রভাব ফেলেনি।
২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন হোয়াইট হাউসে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে স্বাগত জানান, তখন তিনি কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন দুই দেশের ‘বিশেষ বন্ধনের’ কথা। তিনি বলেছিলেন, দুই দেশ ‘শুধু সীমান্তই নয়, আরও অনেক কিছু ভাগ করে।’
তবে ট্রাম্পের সেই বক্তব্য এখন নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের পর থেকে গত কয়েক মাসে ট্রাম্প একাধিকবার কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘৫১তম রাজ্য’ উল্লেখ করে বক্তব্য দিয়েছেন। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, তারা পুরো কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তজুড়ে নতুন নতুন বিরোধ উসকে দিতে প্রস্তুত।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গত সেপ্টেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় কানাোর পানি নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেছিলেন, সেই পানি খরায় আক্রান্ত ক্যালিফোর্নিয়ায় পাইপলাইনের মাধ্যমে নেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘উত্তর থেকে লাখ লাখ গ্যালন পানি পড়ে যাচ্ছে। ওদের কাছে মূলত এক বিশাল কলের মতো জিনিস আছে।’
প্রায় ১ হাজার ৫০০ মাইল পূর্বে গ্রেট লেকস অঞ্চলেও নতুন করে বিরোধ দেখা দিতে পারে। মার্কিন কর্মকর্তারা তাদের কানাডীয় প্রতিপক্ষদের জানিয়েছেন, তারা এই অঞ্চলের যৌথ পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ চুক্তি থেকে সরে আসার কথা বিবেচনা করছেন।
কানাডা মাচিয়াস সিল দ্বীপে থাকা স্বয়ংক্রিয় বাতিঘরের দেখাশোনা করতে সেখানে নিয়মিতভাবে রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীদের পাঠায়। কানাডা বলছে, দ্বীপ যে তাদের নিয়ন্ত্রণের, এটিই তার প্রমাণ। অন্যদিকে, মার্কিনরা যুক্তি দিচ্ছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউএস মেরিন দ্বীপটি দখলে রেখেছিল। সেটাই হচ্ছে তাদের সার্বভৌমত্বের প্রমাণ।
আরও পূর্বদিকে একটি গ্রন্থাগারও বিরোধের নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে কাজ করা ভার্মন্ট-কুইবেক সীমান্তে নির্মিত হ্যাস্কেল ফ্রি লাইব্রেরি ও অপেরা হাউস এখন আর দুই দেশের বাসিন্দাদের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে না।
গত মার্চে যুক্তরাষ্ট্র নতুন একটি নিয়ম চালু করেছে, যার ফলে কানাডীয় নাগরিকদের এখন ওই গ্রন্থাগার ভবনে প্রবেশের আগে অভিবাসনের ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ অবশ্য দাবি করছে, মাদক পাচাররোধে এই নিয়ম চালু করা হয়েছে।

প্রাকৃতিক সম্পদের লড়াই
দুই দেশের মধ্যে বিরোধের আরেকটি কারণ হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ। কানাডার রয়েছে বিপুল পরিমাণে রেয়ার আর্থ মেটাল, স্বর্ণ, তেল, কয়লা ও কাঠ। এসব প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি ট্রাম্প সব সময় আগ্রহী।
অবশ্য ট্রাম্প প্রকাশ্যে দাবি করেছেন, তিনি কানাডার কাঠ, জ্বালানির মজুত বা উৎপাদিত পণ্যের প্রতি মোটেই আগ্রহী নন। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রুী জাস্টিন ট্রুডো কানাডীয় ব্যবসায়ী ও শ্রম নেতাদের সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ভিন্ন কথা বলেন।
তখন সিবিএসে প্রকাশিত ট্রুডোর বক্তব্য ছিল এমন—‘আমি বলি, ট্রাম্প প্রশাসন কেবল জানেই না আমাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রয়েছে। বরং এটাও হতে পারে, তারা এসব সম্পদের জন্যই আমাদের ৫১তম রাজ্য বানাতে বারবার বক্তব্য দিয়ে আসছে। তারা খুব ভালোভাবেই জানে, আমাদের কাছে কী আছে এবং তারা সেগুলো থেকে লাভ করতে চায়।’
কানাডীয় সাংবাদিক ও ‘দ্য বিগ স্টোরি’ পডকাস্টের হোস্ট জর্ডান হিথ-রাউলিংস মনে করেন, ট্রাম্প আসলে চায় কানাডার প্রাকৃতিক সম্পদ। তিনি মনে করেন, ‘একীভূত’ হওয়ার বিষয়ে ট্রাম্পের বক্তব্যকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়।


ট্রাম্প আসলে চায় কানাডার প্রাকৃতিক সম্পদ। একীভূত’ হওয়ার বিষয়ে ট্রাম্পের বক্তব্যকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়
জর্ডান হিথ-রাউলিংস, কানাডার সাংবাদিক


জর্ডান বলেন, তিনি (ট্রাম্প) হয়তো ভাবছেন, বিশাল এক ভূখণ্ড তার শাসনের অধীনে আনা এক বিরাট অর্জন হবে। তিনি সম্ভবত আর্কটিক অঞ্চল চাচ্ছেন, যা ভবিষ্যতে আরও মূল্যবান হয়ে উঠবে।
ট্রাম্পের কাছে এমনকি কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তও সন্দেহজনক। গত মার্চে তিনি বলেছেন, ‘আপনি মানচিত্র দেখলে দেখবেন, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তারা এক সময় একটা কৃত্রিম রেখা টেনে দিয়েছে। কেউ একজন অনেক আগেই এটা করেছিল, আর এর কোনো মানে নেই।’

ভেঙে পড়া আস্থা
ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্য ইতিমধ্যে কানাডার নেতাদের ক্ষুব্ধ করেছে। তাঁরা অভিযোগ করছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের শেষ লক্ষ্য হল কানাডাকে গ্রাস করা।
গত মার্চে ট্রুডো ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেন, তিনি ‘কানাডার অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে চান যাতে আমাদের তাদের সঙ্গে একীভূত করা সহজ হয়।’
এর আগের মাসে ট্রাম্প যখন নতুন করে শুল্ক আরোপ করেন তখন ট্রুডো বলেন, ‘ট্রাম্পের মনে হয়েছে আমাদের দেশকে গ্রাস করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো আমাদের শোষণ করা। আর এটি সত্যিই একটা বাস্তব চিন্তা।’
যুক্তরাষ্ট্রের যদি সত্যিই কানাডাকে তাদের সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা থেকে থাকে, তাহলে তা একটি সাধারণ অথচ জটিল প্রশ্ন সামনে চলে আসে—‘কেন’? শত বছর ধরে কানাডার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র কেন, সেই সম্পর্ক ঝুঁকিতে ফেলতে চাইছে?


নিয়মের চেয়ে বরং ব্যতিক্রম
অনেকে মনে করেন, ট্রাম্পের কানাডা, গ্রিনল্যান্ড ও পানামা খালের প্রতি আগ্রহ একটি এমন একটি নমুনা—যা বিশ্বকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের প্রতিফলন।
বিষয়টি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি গত জানুয়ারিতে বলেছিলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য নিয়মের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিল বলা চলে।’
রুবিও বলেন, ‘আজ আমরা এক বহুমুখী বিশ্বের মুখোমুখি, যেখানে চীন, রাশিয়া ও অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রভাব বাড়ছে।’
কানাডার অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক মাইকেল উইলিয়ামস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন যদি মনে করে বৈশ্বিক আধিপত্য আর সম্ভব নয় বা প্রয়োজনও নেই, তাহলে তারা ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চলের সংঘাতে জড়িয়ে পড়া থেকে নিজেদের দূরে রাখবে।
অধ্যাপক মাইকেল বলেন, এর পরিবর্তে তারা নিজেদের ‘আঞ্চলিক মূলভূমি’ রক্ষা করতে চাইবে। তারা এক ধরনের মহাদেশীয় দুর্গ তৈরি করবে, যার এক পাশে প্রশান্ত মহাসাগর এবং অন্য পাশে আটলান্টিক মহাসাগর।
কানাডার এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে আপনি কৌশলগত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ চাইবেন। আপনি প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার চাইবেন, যা কানাডার প্রচুর আছে এবং যতটা সম্ভব শিল্প দেশেই ফিরিয়ে আনতে চাইবেন।’
অধ্যাপক মাইকেলের এই দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে নতুন নয়। ১৮২০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট জেমস মনরো বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ নিজ নিজ গোলার্ধে থাকুক।
তবে বর্তমান সময়ে ট্রাম্প প্রশাসনের এমন উদ্যোগ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পররাষ্ট্রনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশাল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

পরিকল্পনা না হঠাৎ খেয়াল
অধ্যাপক মাইকেল স্বীকার করেন, আসলে ট্রাম্প কী ভাবছেন, সেটা বোঝা কঠিন।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা জন বোল্টনের সঙ্গে কানাডীয় এই অধ্যাপকের কথা অনেক মিল পাওয়া যায়। বোল্টন বলেছিলেন, ট্রাম্পের কোনো দর্শন নেই। তিনি ভাবনা পান, কিন্তু সেগুলোর কোনো সুসংহত রূপরেখা নেই। কোনো কৌশলগত পরিকল্পনা নেই।
বোল্টন বলেন, বর্তমানে প্রেসিডেন্ট প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি মনোযোগী। তবে এই লক্ষ্য অর্জনের সেরা উপায় হলো বেসরকারি খাত। মিত্রকে নিজের সঙ্গে একীভূত করার চিন্তা নয়।
কানাডা নিজেও যুক্তরাষ্ট্রের খনিজ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যৌথখনন প্রকল্পে কাজ করতে চায়।
তবে অধ্যাপক মাইকেল ও বোল্টন একমত, কানাডার প্রতি ট্রাম্পের আগ্রহ যা–ই হোক না কেন, এতে যে কূটনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। এর পরিণতিও ভয়াবহ হতে পারে।

বিশ্বাস ভঙ্গ

অধ্যাপক মাইকেল বলেন, ট্রাম্প অনেক ক্ষেত্রেই বলে থাকেন, অন্যদের হাতে কোনো তাস নেই। কিন্তু আপনি কাউকে কোণঠাসা করতে থাকলে, তারা হয়তো এমন তাস খেলবে, যেটা আপনি জানতেনই না তারা এমন তাস রাখে। আপনি যতই শক্তিশালী হোন, এর পরিণতি অনেক সময় খুব খারাপভাবে আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
কানাডীয়রা ইতিমধ্যেই মার্কিন পণ্য বর্জন শুরু করেছে। শীত মৌসুমে দক্ষিণে ভ্রমণ বাতিল করছে, যার প্রভাব ফ্লোরিডার পর্যটননির্ভর এলাকাগুলোয় পড়েতে শুরু করেছে।
হিথ–রাউলিংস বলেন, ‘আমরা লড়াই চাই না। তবে কানাডা প্রস্তুত।’
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে আস্থার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়ে কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নির বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। সামনে আবার কানাডার জাতীয় নির্বাচন।
কার্নি সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমাদের অর্থনীতির গভীর সংহতি এবং নিরাপত্তা ও সামরিক সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের যে পুরোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল—তা এখন শেষ। আমি কানাডাকে দুর্বল করার, আমাদের ক্লান্ত করার, ভাঙার এবং শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠার যেকোনো চেষ্টার নিন্দা জানাই।’
১৯ শতকে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সীমানা বরাবর আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনার ঘটনা অনেক বেশি ছিল। ১৮১২ সালের যুদ্ধে মার্কিনরা কয়েকবার কানাডার ভূখণ্ড দখলের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল।
১৮৪৪ সালে প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট অঞ্চলে যুক্তরাজ্যের দাবিকে মেনে না নিলে কিছু মার্কিন নাগরিক সামরিক হস্তক্ষেপের দাবি তোলে।
১৮৫৯ সালে ভ্যাঙ্কুভারের কাছাকাছি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে বিরোধ এবং ব্রিটিশ নাগরিকে একটি শূকর একজন মার্কিন নাগরিকের বাগানে ঢুকে পড়ার কারণে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল।
এসব ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে কেবল ইতিহাসের ধুলোবালি জমা বইয়েই সীমাবদ্ধ ছিল, যেখানে ‘গ্রে জোন’ ছিল ব্যতিক্রমী কূটনীতি। এক শান্তিপূর্ণ বিশ্বে একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। এটি দুই দেশের উন্নত ও সংহত গণতন্ত্রে খুব প্রভাব ফেলতে পারিনি।
এখন সেই শান্ত পরিস্থিতি ভেঙে গেছে। এই উত্তাল পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোনদিকে যে গড়াবে, সেটি নিয়ে কেউই নিশ্চিত নন।

বিবিসি