গুগল, মেটা, অ্যাপলসহ যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর একচেটিয়া ব্যবসা চলে আসছে বছরের পর বছর। এতে বছরে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হলেও বিভিন্ন মামলার তোপে পড়তে হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সম্প্রতি দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতির চাপও নিতে হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানকে। চলতি সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের অ্যান্টি ট্রাস্ট মামলার ঝুল দেখা যাচ্ছে আদালতে।
বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের মামলায় গুগল
অনলাইন বিজ্ঞাপনের বাজারে গুগলের একচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে মামলা করেছে মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট এবং দেশটির ১৭টি রাজ্য। অভিযোগ উঠেছে, কোন বিজ্ঞাপন কোথায় দেখানো হবে, সেটি গুগল নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ধ্বংসের অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। ভার্জিনিয়ার ফেডারেল জাজ লিওনি ব্রিঙ্কেমা তাঁর রায়ে বলেছেন, ‘একাধিক প্রতিযোগিতাবিরোধী কাজ গুগলের ইচ্ছাকৃত। এর মাধ্যমে তারা অ্যাড টেক বাজারে একচেটিয়া ক্ষমতা ধরে রেখেছে।’
আদালতে গুগলের বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তবে তৃতীয় একটি অভিযোগ খারিজ করা হয়। মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট চায়, গুগলকে বাধ্য করা হোক তার ‘গুগল অ্যাড ম্যানেজার’ বিক্রি করতে। এদিকে গুগলের রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স প্রধান লি অ্যান মুলহল্যান্ড জানিয়েছেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। গুগলের দাবি, পাবলিশারদের অনেক বিকল্প থাকলেও তারা অ্যাড টেক সরঞ্জাম সহজ, সাশ্রয়ী ও কার্যকর হওয়ার কারণে গুগলকে বেছে নেয়।
ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ হারাতে পারে মেটা
ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার বিরুদ্ধে চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ আদালতে একটি মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, মেটা বেআইনিভাবে বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য গড়ে তোলার জন্য বিলিয়ন ডলার খরচ করে হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম কিনে নিয়েছিল। তাতে সোশ্যাল মিডিয়া খাতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা ধ্বংস হয়েছে। মার্কিন ফেডারেল ট্রেড কমিশনে মামলাটি প্রথম করা হয় ২০২০ সালে—ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম শাসনামলে। তারা চায়, মেটাকে বাধ্য করা হোক ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্মগুলো আলাদাভাবে বিক্রি করতে।
গত ১৪ এপ্রিল ওয়াশিংটনে ফেডারেল কোর্টে মামলার সাক্ষ্য দিতে হাজির হয়েছিলেন মার্ক জাকারবার্গ। তাঁর দাবি, সোশ্যাল মিডিয়ায় টিকটক, এক্স বা ইউটিউবের মতো শক্তিশালী প্রতিযোগী থাকার পরেও মেটার একচেটিয়া আধিপত্যের অভিযোগটি ভিত্তিহীন।
ধারণা করা হচ্ছে, এটি হতে যাচ্ছে মার্কিন ফেডারেল ট্রেড কমিশনের নতুন নেতৃত্বের অধীনে প্রথম বড় প্রযুক্তি মামলা। বিচারক জেমস বোয়াসবার্গ এরই মধ্যে জানিয়েছেন, মার্কিন ফেডারেল ট্রেড কমিশন যদি মামলায় জয়ী হয়, তবে মেটা বিভাজনের মুখোমুখি হতে পারে।
আমাজনের মামলার দিকে তাকিয়ে ই-কমার্স ব্যবসা
একচেটিয়া আধিপত্য তৈরির অভিযোগে অ্যান্টি ট্রাস্ট মামলার মুখে পড়েছে বিশ্ববিখ্যাত অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্ম আমাজন। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশন এবং দেশটির ১৭টি অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেলরা আমাজনের বিরুদ্ধে এই মামলা করেন। তাঁদের অভিযোগ, আমাজন পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে, সার্চ ফলাফল বিকৃত করে এবং বিক্রেতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত চার্জ নিয়ে মার্কিন প্রতিযোগিতা আইন লঙ্ঘন করছে। তবে আমাজন আদালতে দাবি করে, আইনি প্রক্রিয়া না মেনে কেউ সরাসরি আদালতে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাওয়ার অধিকার রাখে না। কিন্তু মার্কিন জেলা বিচারক জন চুন এই যুক্তি মানেননি।
এই মামলার ফলাফল শুধু আমাজনের জন্য নয়, পুরো ই-কমার্স খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এতে নির্ধারিত হবে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে কীভাবে কাজ করবে। এই মামলায় আমাজন হেরে গেলে প্রতিষ্ঠানটিকে তাদের ব্যবসায়িক মডেল পরিবর্তন করতে হবে। সেই সঙ্গে বিলিয়ন ডলার জরিমানা তো রয়েছেই।
অ্যাপলের বিরুদ্ধে মিথ্যা বিজ্ঞাপন প্রচারের অভিযোগ
সম্প্রতি অ্যাপলের বিরুদ্ধে মার্কিন ফেডারেল আদালতে একটি মামলা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, অ্যাপল তাদের বিজ্ঞাপনে এমন কিছু নতুন এআই ফিচারের কথা বলেছে, যা বাস্তবে এখনো কোনো অ্যাপল ডিভাইসে যুক্ত হয়নি। এ জন্য ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবহারকারীদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে মামলায়। অ্যাপল গত বছর একটি টিভি বিজ্ঞাপনে দাবি করেছিল, তাদের ভার্চুয়াল সহকারী সিরিতে নতুন কিছু স্মার্ট ফিচার যোগ করা হয়েছে। অ্যাপল নিজেই স্বীকার করেছে, এই প্রযুক্তি চালু করতে তাদের ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যাবে।
যিনি মামলা করেছেন, তাঁর দাবি, এই মিথ্যা বিজ্ঞাপন দেখে অনেকে নতুন আইফোন বা অ্যাপল পণ্য কিনেছেন। কিন্তু প্রতিশ্রুত ফিচার না পেয়ে তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন। অ্যাপল ইচ্ছা করে ভুল তথ্য দিয়ে গ্রাহকদের প্রলোভন দেখিয়েছে—আদালতে যদি বিষয়টি প্রমাণিত হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠানটিকে বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হতে পারে।
এই মামলাগুলো প্রযুক্তিশিল্পে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের প্রাধান্য কমলে নতুন প্রতিযোগীর জন্ম হতে পারে। আমাজন যদি মামলায় হেরে যায়, তাহলে ছোট বিক্রেতাদের সুযোগ বাড়বে। অ্যাপলের ক্ষেত্রে আইফোন ব্যবহারকারীরা প্রতারিত হবে না কিংবা অন্য ডিভাইস ব্যবহারেও তারা উৎসাহিত হবে। মার্কিন সরকারের এই মামলা প্রমাণ করছে, টেক জায়ান্টদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ নীতি করা হতে পারে ভবিষ্যতে। তাতে ভোক্তাস্বার্থে এই লড়াইয়ের ফল পুরো টেক শিল্পের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে।
সূত্র : রয়টার্স, বিবিসি ও টেকক্রাঞ্চ