আমেরিকার শ্রম বাজারে তীব্র কর্মী সংকট চলছে। কাজের জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না। কেবল নিউইয়র্কেই প্রতি ১০০টি খালি পদের জন্য ৮৭ জন লোককে পাওয়া সম্ভব। নির্মাণ,পরিবহণ, বিভিন্ন ধরনের সেবা খাতসহ সর্বত্র মজুরি বৃদ্ধি করেও লোক পাওয়া যাচ্ছে না। চাকুরির বাজারের এমন রমরমা অবস্থার সুযোগ অনেকেই গ্রহণ করছে। বাংলাদেশি নতুন অভিবাসীদের অনেকেই চাকুরি বাজারের চলমান চাঙ্গা অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করতে পারছেনা। প্রয়োজনীয় তথ্য ও সংযোগের অভাবে অজানা থেকে যাচ্ছে আমেরিকায় নিজেকে গড়ে তোলার কৌশলটি।
সাম্প্রতিক ইতিহাসে চাকুরি বাজারে এমন রমরমা অবস্থা কখনো দেখা যায়নি। মহামারির সময়ে শ্রমবাজার থেকে ঝরে পড়া অনেক কর্মীই আর কাজে ফিরে যাননি। নতুন আসা অভিবাসীরা বিভিন্ন পেশায় নিজেদের যুক্ত করবেন, এমন প্রত্যাশা থাকলেও অভিবাসীরা আমেরিকায় এসেই যেকোনো গতানুগতিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এবং বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য দক্ষতা অর্জন করছে না। বাংলাদেশি অভিবাসীদের বেলায় এ সত্যতা আরও বেশি।
অধিকাংশ বাংলাদেশি আমেরিকায় আসে পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করেন। নানা ধরনের ডেলিভারি, গাড়ি চালানো, হোটেল রেস্তোরাঁয় কাজে নেমে পড়েছেন। কিছুদিন জড়িয়ে থাকার পর প্রান্তিক কোন পেশা বদল করছেন না। আমেরিকার বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা কাজে লাগিয়ে এখানকার শ্রমবাজারের দক্ষ কর্মী হিসেবে অনেকেই নিজেকে উচ্চ আয়ের পেশায় যুক্ত করতে পারেন। এ নিয়ে নতুন আসা অভিবাসীদের যারা পথ দেখাতে পারেন, তারাও কাজটি করছেন না।
বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় আসা অভিবাসীরা অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অগ্রসর। অনেকেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে এসে এখানে গাড়ি চালিয়ে বা হোটেল রেস্তোরাঁয় কাজ করে জীবন পার করে দিচ্ছেন। কথার ফাঁকে অনেকেই অজুহাত হিসেবে বলেন ইংরেজি না জানার কারণে তারা এগোতে পারছেন না। যদিও যেকোনো বয়সে ইংরেজি শেখার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া অভিবাসীবহুল নগরগুলোতে এক বর্ণ ইংরেজি না জেনেও বহু পেশাজীবী তাদের কাজে এগিয়ে থাকতে দেখা যায়। আমেরিকায় মধ্য পর্যায়ের যেকোনো কাজের জন্য স্কুল গ্রাজুয়েশন হয়েছে কি না, তা জানতে চাওয়া হয়। বাংলাদেশ থেকে আসা অধিকাংশ নারী পুরুষ অভিবাসীরাই উচ্চমাধ্যমিক পাশ। এ শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বহু উচ্চ আয়ের পেশায় যোগ দেয়ার সুযোগ রয়েছে।
ফেডারেল অর্থ ব্যবহার করে যত উন্নয়ন কাজ আমেরিকা জুড়ে হয়, সেসব কাজে কর্মি নিয়োগসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসা বাণিজ্যে অনগ্রসর সম্প্রদায় থেকে কর্মি নিয়োগের বাধ্যবাধকতা থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলে যায়, ফেডারেল থেকে বরাদ্দ অর্থের ব্যবহার করে কোন আবাসিক প্রকল্প বা অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ করা হলে, এলাকা অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে বসবাস করা লোকজনকে এসব প্রকল্পে সংযুক্ত করতে হয়। এমনকি অল্প আয় বা মধ্য আয়ের লোকজনকে একটি নির্দিষ্ট হারে নিয়োগ না দিলে বরাদ্দের অর্থ ছাড় পাওয়া যায় না। নিউইয়র্ক, নিউজার্সিসহ বড়বড় রাজ্যগুলোতে আগামী এক দশকে এমন অসংখ্য প্রকল্প বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। এসব প্রকল্পের জন্য কর্মীদের প্রস্তুত করার জন্য বিভিন্ন শহরে বেশ কিছু সংস্থা কাজ করছে। সরকারের অর্থ সহযোগিতায় এসব সংস্থা জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেয়া ছাড়াও প্রশিক্ষণ ভাতা , যাতায়াতের ব্যয় পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে।
নিউইয়র্ক বা নিউজার্সিতে এমন কোন বাংলাদেশি সংস্থার সন্ধান পাওয়া যায়নি। যারা সরকারের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে লোকজনের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছেন। বাংলাদেশি জনসংঠনগুলো জেলা ও থানার নামে সমিতি করে বনভোজন করা আর কবর ক্রয়ের কর্মসূচি নিয়ে দলাদলি আর কলহে ব্যস্ত। না হয়, মসজিদ, মন্দির নির্মাণ নিয়ে নিজেরা মারামারি করছেন।
নিউইয়র্ক ও নিউজার্সির রাজ্য সরকারের মাধ্যমে অনুদান গ্রহণ করে বেশ কিছু সংস্থা অভিবাসীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এসব প্রশিক্ষণে নির্মাণ শ্রমিক থেকে শুরু করে আইটি খাত পর্যন্ত সব পেশায় দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। একাধিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে এসব কর্মসূচিতে কোন বাংলাদেশি অভিবাসী নেই।
আমেরিকায় নির্মাণ কাজ থেকে যেকোনো প্রকল্প কাজে যুক্ত হতে হলে লাইসেন্সিং করা বাধ্যতামূলক। নির্মাণ কাজের একজন পতাকা শ্রমিক(যিনি সড়ক পথের নির্মাণ কাজের পতাকা ধরেন গাড়ি বা পথচারিকে সতর্ক থাকার জন্য), তাঁকেও লাইসেন্স নিতে হয়। এসব লাইসেন্স পাওয়া তেমন কোন কঠিন কাজ নয়। যদিও এসব কাজের মজুরি ঘণ্টায় কখনো ৪০ ডলারের কাছাকাছি।
অভিবাসীদের মধ্যে যেসব পরিবার ফুড স্ট্যাম্প গ্রহণ করেন বা মেডিকেইড গ্রহণ করেন, তাদের বিভিন্ন কাজে নিয়োগ দেয়ার জন্য অগ্রাধিকার দেয়া হয়। যদিও এসব অগ্রাধিকার পাওয়া কর্মীদের কাজের সন্ধান করতে দেখা যাচ্ছে না।
আমেরিকা জুড়ে এখন বেকারত্বের হার চার শতাংশের নিচে। শুধু নিউইয়র্কেই সাড়ে চার লাখ চাকুরির পদ খালি পড়ে আছে। আগামী এক দশকে নিউইয়র্ক ও নিউ জার্সিতে উইন্ড টানেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় বড় প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। এসব প্রকল্পের জন্য প্রান্তিক শ্রমিক থেকে শুরু করে নির্বাহী পর্যায়ের হাজার হাজার কর্মীর প্রয়োজন। বিভিন্ন অভিবাসী দল এবং অনগ্রসর এলাকার লোকজন ব্যাপকভাবে এসব কাজে জড়িত হওয়ার জন্য নিজেদের দক্ষ করে তোলার এখনই প্রস্তুতি শুরু করেছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বেকার থাকা বা নিম্ন মজুরীতে কাজ করা লোকজনের মধ্যে মাত্র পাঁচ শতাংশ কাজের খোঁজ করছে বা নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে মনোযোগী হচ্ছে।
বিভিন্ন রাজ্যে খালি পদের বিপরীতে লোক নেই। ফলে কাজ কর্ম থমকে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ বিরাজ করছে। ইউ এস চেম্বার এবং ইউ এস চেম্বার ফাউন্ডেশন ব্যবসা মালিকদের 'আমেরিকা ওয়ার্ক ইনিশিয়েটভ' নামের কর্মসূচির মাধ্যমে দক্ষ কর্মীদের সন্ধান ও শ্রমবাজারের উপযোগী করার জন্য নানা ধরনের সহযোগিতা করছে। এসব সহযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতিসহ আমেরিকার চাঙ্গা শ্রমবাজারে উচ্চ মজুরীতে কাজ করার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করার কোন বিকল্প নেই। এ নিয়ে প্রতিটি এলাকায় কর্মসংস্থান অফিস, চেম্বার অব কমার্সসহ নানা সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সাথে যেকেউ যোগাযোগ করে সংযোগ সৃষ্টি করার সুযোগ রয়েছে।