নিউইয়র্কে স্ক্যামারদের ফাঁদে পা 

বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর ৯ মিলিয়ন ডলার উধাও

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৯ জুন ২০২৪, ২১:৪৯


স্ক্যামারদের ফাঁদে পা দিয়ে অতি লোভে বিনিয়োগ করেছিলেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশি একজন ব্যবসায়ী। এরপর তিনি সর্বস্ব খুঁইয়েছেন। প্রায় ৯ মিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছে স্ক্যামাররা। এই স্ক্যামাদের মুল হোতা একজন রুশ নারী। সব হারিয়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী এখন নিউইয়র্ক পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে।
জানা গেছে, ২০২৩ সালের শুরুতে ব্রঙ্কসের বাসিন্দা ও বরিশাল প্রবাসী জনৈক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী একটি টেক্সট  মেসেজ রিসিভ করেন। তাকে নানাভাবে প্রলোভন দেখানো হয়। তাকে সাইবার বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়। প্রথমে অল্প বিনিয়োগ করে স্ক্যামারদের আহ্বানে সাড়া দেন। সেখানে থেকে কাঙ্খিত মুনাফাও  আসে। এরপর যেটুকু বিনিয়োগ করেন, তা থেকে সন্তোষজনক মুনাফা পেতে থাকেন। এভাবে তিনি ৯ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন। আর এই বিনিয়োগ করতে গিয়ে তিনি নানা মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। নিজের বাড়ি বিক্রি করেছেন। ব্যাংক থেকেও মোটা অংকের ঋণ নিয়েছেন। শেষমেষ ৯ মিলিয়ন ডলার তিনি খুঁইয়েছেন। 
ব্রঙ্কসের একটি প্রিসিঙ্কটে বাংলাদেশি ওই ব্যবসায়ী প্রথমে অভিযোগ করেন। এরপর পুলিশ প্রাথমিক তদন্ত শুরু করে। স্থানীয় পুলিশের প্রিসিঙ্কট অনুসন্ধান করে জানতে পারে, ওই ব্যবসায়ী আন্তর্জাতিক স্ক্যামারদের খপ্পড়ে পড়েছেন। পরে নিউইয়র্ক পুলিশের একটি বিশেষ শাখা বিষয়টির তদন্ত করছে। 
প্রাথমিক অনুসন্ধানে পুলিশের ওই বিশেষ শাখাও নিশ্চিত হয়েছে যে বাংলাদেশি ওই ব্যবসায়ী স্ক্যামারদের ফাঁদে পা দিয়েছেন। তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন, আমি বিশ্বাস করি আমি ক্রিপ্টো কেলেঙ্কারির শিকার। সানফ্রান্সিসকোর একটি মেয়ে টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। এরপর দীর্ঘ কথোপকথনের পরে, আমি প্রথমে ১০০ ডলার বিনিয়োগ করেছি। আমি কয়েনবেসে বিটকয়েন কিনেছিলাম এবং তারপরে কুনা অ্যাপে স্থানান্তরিত হয়। একটি নির্ধারিত দিন এবং সময়ে, আমি তার নির্দেশাবলী অনুসরণ করেছি। 
এক ক্লিকে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে ১০% লাভ করেছি। ভুল করে আমি আবার ক্লিক করেছি এবং ১০% এর চেয়ে বেশি লোকসান দেই।  সেই দিনের পর আমি আরও বেশি করে ডলার যোগ করেছি এবং তার নির্দেশাবলী সঠিকভাবে অনুসরণ করেছি এবং কখনই আর লোকসানের মুখোমুখি হইনি। এটাই ছিল তাদের কৌশল বা ফাঁদ, যে ফাঁদে আমি পা দিয়েছি। 
বাংলাদেশি ওই ব্যবসায়ী জানিয়েছেন- স্ক্যামাররা তাকে বিনিয়োগ করার জন্য ছক দিয়েছিল। ০- ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে ১০% লাভ/ক্ষতির জন্য যেকোনো পরিমাণ। ৬০ সেকেন্ডে ২০% লাভ/ক্ষতির জন্য ২০ হাজার এবং তার বেশি, ১২০ সেকেন্ডে ৩০% লাভ/ক্ষতির জন্য ৫০ হাজার এবং তার বেশি, ১৮০ সেকেন্ডে ৪০% লাভ/ক্ষতির জন্য ২০০ হাজার (২ লাখ) এবং তার বেশি, ৫০০ হাজার (৫ লাখ) এবং তার বেশি ৫০% লাভ/ক্ষতির জন্য ৩০০ সেকেন্ডে এবং ৮০০ হাজার (৮ লাখ)  এবং তার বেশি ৮০% লাভ/ক্ষতির জন্য ৬০০ সেকেন্ডে। 
ওই রুশ নারী স্ক্যামার তাকে বলেছিলেন যে তার চাচা এবং তার আরও কয়েকজন বন্ধু স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে অবসর নিয়েছেন এবং একটি ব্যবসা তৈরি করেছেন। বাড়িতে তাদের স্টেশন। তারা প্রতি মাসে একবার বা দুবার একটি ব্যবসা করে এবং প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। তাদের অনেক অভিজ্ঞতা আছে, তারা বাজারের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে কখন বিটকয়েন উপরে যাবে বা নিচে নামবে। এ ব্যাপারে তারা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে এবং শুধুমাত্র ১০০% নিশ্চিত হলেই বাজারে প্রবেশ করবে। তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে ধীরে ধীরে আমি এবং আমার কয়েকজন বন্ধু মিলে বিনিয়োগ করেছি প্রায় এক মিলিয়ন ডলার এবং আমাদের একটি বিশাল লাভ ছিল। ডিসেম্বর, ২০২৩-এ, আমি ২০ হাজার ডলার তুলে নেই। তখন আমার অ্যাকাউন্টে প্রায় ৯ মিলিয়ন ডলার ছিল। আমি ৩ মিলিয়ন তোলার চেষ্টা করেছি ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। কোম্পানির কাছ থেকে তখন একটি ইমেল পেয়েছি। আমাকে ১০৮১ হাজার  ট্যাক্স দিতে বলা হয়েছিল আমার লাভের অনুকূলে। 
আমি এটা নিয়ে তাদের সাথে তর্ক করি এবং তারা বলে যে আমি ট্যাক্স না দিয়ে তুলতে পারব না। 
রুশ নারী শুরু থেকেই আমাকে সাহায্য করার কথা বলেছে। সে জানায়, আমাকে প্রায় ৬ লাখ ডলার ট্যাক্স দিতে হবে। সে আমার পক্ষে আমার ট্যাক্স দেবে এবং যখন আমি ডলার তুলতে পারবো তখন আমি তার জন্য অর্থ প্রদান করব। আমি সম্মত হলে ওই নারী তাকে জানায় যে সে তার জন্য ১০৫০ হাজার ডলার (প্রায় ১ মিলিয়ন) পেমেন্ট করেছে। তাৎক্ষণিক তাকে ৩১ হাজার ডলার দিতে হয়েছে। আমি পেমেন্টের জন্য কনফার্মেশনও পেয়েছি। তারপর আমি অংশীদারদের সাথে কথা বলেছি। এর পরে আমি আরেকটি ইমেল পেয়েছি যে আমাকে জরিমানা হিসাবে আরও ১৭ হাজার ডলার দিতে হবে দেরিতে ট্যাক্স পেমেন্টের কারণে। তারপর আমরা আরও ১৭ হাজার জরিমানা দিয়েছি। তারপর আরেকটা পেলাম ইমেল, যাতে বলেছে, আমি প্রায় ৩ মিলিয়ন উত্তোলনের জন্য ১১টি লেনদেন করেছি। তারা নিরাপত্তা তল্লাশি করেছে আমার ওপর এবং সবকিছু ভাল আছে। এখন আমাকে ১০ হাজার ডলার ফি দিতে হবে। তারপর আমি তাও পরিশোধ করেছি। এখন তারা পাঠিয়েছে আমাকে আরেকটি ইমেল, যেখানে বলেছে- রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাকে ১০০ হাজার নিরাপত্তা আমানত দিতে হবে বর্ডার ক্রসিংয়ের জন্য, যা ৩০ দিনের মধ্যে ফেরত দেওয়া হবে। আমি এটি দিতে অস্বীকার করেছি। তখন সে আমার জন্য ১০০ হাজার ডলার (এক লাখ) দিতে তার আরও ১৫ হাজার ডলার প্রয়োজন বলে জানায়। প্রতিবার তারা আমাকে ইমেল পাঠায়। তারা বলেছিল- আমি নির্ধারিত তারিখের আগে অর্থ প্রদান না করলে প্রতিদিন ৫% জরিমানা হবে। আমি তাদের বলেছিলাম আমি কোনো জরিমানা দিতে পারবো না। আমি তাদের বলেছিলাম যে আমি তাদের বিষয়টি এফবিআইকে রিপোর্ট করব। তখন তারা আমাকে পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেছিল, এজন্য তারা আমাকে সর্বনিম্ন ১ বছর এবং সর্বোচ্চ ৫ বছরের জন্য আমার অ্যাকাউন্টের অর্থ ফ্রিজ করবে। এটিই ছিল তাদের সাথে শেষ ইমেল। 
নিউইয়র্ক পুলিশের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, পুলিশ স্ক্যামারদের সনাক্ত করেছে। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে তাদের কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখছে পুলিশ। স্ক্যামারদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো গোষ্ঠী জড়িত কী না তা কঠোরভাবে মনিটরিং করছে পুলিশ। 
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে স্ক্যামারদের এই ফাঁদ নতুন নয়। তাদের ফাঁদে পা দিলে নিশ্চিত সর্বস্ব খোয়াতে হবে। এ ব্যাপারে নিউইয়র্ক পুলিশ নগরবাসীর মাঝে সচেতনতা বাড়াতে নানান কার্যক্রম চালাচ্ছে। পুলিশ বলছে- নানাভাবে স্ক্যাম হচ্ছে। স্ক্যামের ধরণ পাল্টাচ্ছে স্ক্যামাররা। তাই যে কোনো লেনদেনে সন্দেহজনক ও অস্বাভাবিক কিছু মনে হলে পুলিশের সাহায্য নেওয়া উচিত।