দ্য ডিপ্লোমেটের প্রতিবেদন

শেখ হাসিনার শাসনের সমালোচনা করার মূল্য দিচ্ছে আমেরিকা?

ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৬ জুন ২০২৪, ১৬:৪০


আমেরিকার তৈরি বোয়িং বিমান ব্যবহারের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সম্প্রতি ইউরোপে তৈরি চারটি উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিমান বাংলাদেশের বহরে ২০টিরও বেশি উড়োজাহাজ রয়েছে। যার বেশিরভাগই বড় আকারের বোয়িং উড়োজাহাজ এবং কিছু ড্যাশ-৮ টার্বোপ্রপস।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বড় আকারের এয়ারবাস এ-৩০ বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিমান নিজস্ব মূল্যায়ন কমিটি দ্বারা বিমানটির মূল্যায়নের বিরুদ্ধে গিয়েছিল, যা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আবিষ্কার করেছিল যে এয়ারবাস বিমান কিনলে বিমান বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, বড় আকারের এয়ারবাস এ-৩০ কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বিমান তার নিজস্ব মূল্যায়ন কমিটির বিরুদ্ধে গিয়েছিল। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে কমিটি বলেছিল যে, এয়ারবাস বিমান কিনলে বিমান বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
ওই কমিটির প্রতিবেদনের পর সরকার আরেকটি মূল্যায়ন কমিটি নিয়োগ করে। এই কমিটি দেখতে পায়, এয়ারবাস উড়োজাহাজ কেনা বিমানের জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক হবে। সরকার এয়ারবাস বেছে নিতে  দ্বিতীয় মূল্যায়নটাকে বেছে নিয়েছে।
প্রতিটি এয়ারবাস বিমানের মূল্য ১৮০ মিলিয়ন ডলার এবং প্রতিটি বিমানের জন্য অ-ফেরতযোগ্য ৫ মিলিয়ন প্রতিশ্রুতি ফি। দেশের অর্থনীতি যখন দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং ডলার সংকটের কবলে পড়েছে, তখন বাংলাদেশকে চারটি এয়ারবাস বিমানের জন্য এই পরিমাণ অর্থ ছাড় করতে হবে। ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী মার্কিন কোম্পানিগুলো মুনাফা পাঠাতে পারছে না বলে পরিস্থিতি ভালো নয়।
বিমানের বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিজুল আজিম এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলেন, বোয়িংকে ঘিরে সাম্প্রতিক নিরাপত্তা উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা এড়ানোর আকাঙ্ক্ষা থেকেই এয়ারবাস উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, এয়ারলাইন্সের বহরে বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে বিমান এর দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।
আজিমের এই যুক্তি ভিত্তিহীন নয়। দুর্ঘটনা, তাদের বিমানের ত্রুটি এবং গ্রাহকদের কাছে বিমানের ধীর সরবরাহের কারণে বোয়িং গুরুতর বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। ফলে বিশ্বজুড়ে ৩২ বিলিয়ন ডলার লোকসান করেছে প্রতিষ্ঠানটি। গ্রাহকরা এই আইকনিক আমেরিকান সংস্থা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি আরবের ক্ষেত্রে, তারাও সম্প্রতি ১০৫টি এয়ারবাস বিমানের অর্ডার দিয়েছে।
তবে বিমানের এয়ারবাস উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত আর্থিক বা ব্যবসায়িক যুক্তি দ্বারা প্রভাবিত নয়। বরং এটি ভূ-রাজনীতি এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে বলে মনে হয়।
এভিয়েশন খাতে ব্যবসায়িক স্বার্থের চেয়ে রাজনীতিকে প্রাধান্য দেওয়া বাংলাদেশের জন্য নতুন নয়। বিমান গবেষকদের মতে, বিমান শিল্প পরিষেবা বা পণ্য সম্পর্কিত বেশিরভাগ ব্যবসায়ের থেকে পৃথক কারণ এটি সরাসরি জাতীয় স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব এবং দেশগুলোর প্রতিপত্তির সাথে জড়িত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, বেসামরিক বিমান চালনার রাজনীতি দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে। সরকার সেই দেশকে কীভাবে দেখে এবং দেশের নাগরিকরা তাদের নিজস্ব এবং বিদেশি দেশগুলিকে কীভাবে দেখে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এবং এর বেশ কয়েকজন শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এরপর ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের বিতর্কিত একতরফা সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বানচালকারী কর্মকর্তা ও রাজনীতিকদের জন্য ভিসা বিধিনিষেধ ঘোষণা করে। সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগে বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের কড়া জবাব দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ওয়াশিংটনকে তার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য অভিযুক্ত করেন এবং সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ না করে তিনি দাবি করেন যে, একটি দেশ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ভূখণ্ড ব্যবহার করে পূর্ব তিমুরের মতো একটি বিমান ঘাঁটি এবং খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করছে। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বোয়িং থেকে সরে আসার সিদ্ধান্তটি সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের প্রতি ঢাকার প্রতিক্রিয়ার অংশ। এয়ারবাস বিমান কেনার ফলে ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যের মতো ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যেও হতে পারে, যারা এয়ারবাস বিমানের বিভিন্ন অংশ তৈরি ও সংযোজন করে। এয়ারবাসের ঘটনাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বৈদেশিক নীতির অগ্রাধিকারগুলোতেও ফাটল ধরিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ফলাফলের দিকে মনোনিবেশ করেছে, এমনকি স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতিতে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনকে 'অবাধ বা সুষ্ঠু নয়' বলে বর্ণনা করেছে, তখন ইউরোপীয় দেশগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গভীর করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের প্রতিক্রিয়ায় কম কঠোর ছিল, কেবল সীমিত ভোটার অংশগ্রহণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল এবং সরকারকে আরও স্বচ্ছতার দিকে কাজ করার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছিল।

২০২৩ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ১০টি এয়ারবাস বিমান বিক্রির ঘোষণা দেন। সফর শেষে জারি করা যৌথ বিবৃতিতে 'সমৃদ্ধি, শান্তি ও জনগণের' কথা উল্লেখ করা হলেও ম্যাক্রোঁ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের স্পষ্ট সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকেন।
বাংলাদেশের কাছে এয়ারবাস বিমান বিক্রির ফলে ফ্রান্স এবং অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তিগুলো আমেরিকানদের ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। যেখানে মার্কিনিরা ঐতিহ্যগতভাবে দ্বিপাক্ষিক বিমান পরিষেবা চুক্তিগুলো ব্যবহার করে অনেক ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতেছে।
পশ্চিমা দেশগুলোর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হাসিনাকে সুবিধা দিয়েছে। এয়ারবাস বিমান কেনা সম্ভবত গণতন্ত্রের জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর যে কোনো চাপ কমিয়ে দেবে।
তথ্যসূত্র: দ্য ডিপ্লোমেট