নিউইয়র্ক, ডেট্রয়েট,টেক্সাস, হিউস্টন, ওহিও, লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে বিনোদন রাজধানী লাসভেগাস কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সব চেয়ে ছোট রাজ্য থেকে সব চেয়ে বড় রাজ্য, সবচেয়ে বড় শহর থেকে সব চেয়ে ছোট শহরের কোনায় কোনায় অভিবাসী বাঙালিরা বাংলাদেশের দূত হিসেবে ছড়িয়ে আছেন।এই শহর গুলো কিংবা যে সব শহরের নাম উচ্চারিত হলোনা এ'গুলো এখন ভার্চ্যুয়ালী আমাদের খুব পরিচিত। মার্কিন মুল্লুকের জনসমাজে, স্থানীয় সরকার কাঠামোতে বাংলাদেশীরা ধীরে ধীরে দাপটের সাথে প্রভাব বিস্তার করছেন। আমাদের স্বজন, বন্ধুদের পরবর্তী প্রজন্ম বিজ্ঞান, প্রকৌশল, মার্কেটিং, পরিবেশবিজ্ঞান, কর্পোরেট সেক্টর সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দাপুটে নির্বাহী থেকে ধীরে ধীরে আরও উচ্চ পদে আসীন হচ্ছেন। নাসাতে বিজ্ঞানী হিসেবে যেমন কাজ করছেন একই ভাবে বুয়েট থেকে পাশ করা কম্পিউটার প্রকৌশলী এমি এওয়ার্ডের মতো সম্মানজনক পদকও ছিনিয়ে নিচ্ছেন। শৈশব থেকে শুনতাম বাঙালির ব্যবসা বাণিজ্যের দক্ষতা নেই। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে জানতে পাই, দেখতে পাই আমাদের বন্ধুরা এন্টিক থেকে শুরু করে এমন কোন ব্যবসা নেই যা'তারা করছেন না। দেশে যারা ছিলেন পাড়ার মোড়ে কিংবা চায়ের দোকানে আড্ডায় মত্ত তাদেরকে দেখি সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবনকে সাজাতে, জীবিকায় গভীর মনোযোগ দিতে।
যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রক্রিয়া যখন কিছুটা সহজ হতে শুরু করলো বিশেষ করে আশির দশকের শেষের দিক থেকে আমরা অভিবাসীদের চোখ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে দেখতে শুরু করেছি। অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের মুখাবয়ব দেখতে আমাদের সহায়তা করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেমন দেশ? জটিল রাজনীতি কিংবা কূটনীতির মারপ্যাচে না গিয়ে অভিবাসীদের ভাষ্যে আমাদের সামনে একটি ছবি দাঁড়িয়ে যায়।বাঙালি অভিবাসীরা এই ধারণা প্রদানের ক্ষেত্রে দুই দেশের মানুষের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করছেন। অভিবাসী স্বজনদের দৃষ্টি দিয়ে অধিকাংশ বাংলাদেশী এখন ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকানদেরদের অন্দর ও বহিরাঙ্গকে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। এ'ছাড়া দেশটির বৈচিত্র্য পিয়াস, বৈচিত্র্যের মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজে বেড়ানো; বর্ণবাদ বিরোধি অবস্থান, মানবাধিকারের সকল সূচক অর্জনের সর্বোচ্চ চেষ্টার কথা এখন স্বজনদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারি। নাগরিকদের বিষয়ে সরকারের স্বতঃস্ফুর্ত দায় এবং এই দায়, দায়ীত্ব পালনে কল্যান মূলক রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রমের কথা জেনে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী কিছুটা হলেও পালটে যায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ মৌলিক অধিকার পূরনে রাজ্য কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচেষ্টা গুলো বাঙালিদের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে এক অনিন্দ সুন্দর দারণা দিতে সমর্থ হয়।
আমরা যারা ষাটের দশকে জন্ম নিয়েছি তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ব্যারোমিটারের উঠানামা নানা ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি।রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক দশকে, অর্ধ দশকে উঠা নামা করেছে। বাংলাদশের রাজনীতি এবং জাতীয় উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি দেশ, যে দেশকে কোন ভাবে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতিতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের জনসমাজের ভেতর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের গভীরতা এতোই প্রবল, প্রভাব এতোই গভীর যে দেশের অতীত, বর্তমান এমনকি ভবিষ্যতের পথ চলায় যুক্তরাষ্ট্রের যুক্ততা অবশ্যম্ভাবী। ক্রমাগত ছোট হয়ে আসা পৃথিবীকে আমরা বলি ভূ-গ্রাম, এই ভূগ্রামে বাংলাদেশের ভৌগোলিক উপস্থিতি এতোই গুরুও্বপূর্ণ স্থানে যে, কৌশলগত কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও উদীয়মান বাংলাদেশকে নিজেদের অর্থনৈতিক, সমরনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিকল্পনায় বিয়োজিত রাখা এখন সম্ভব নয় বলে মনে হয়।
একাত্তর পূর্ব, একাত্তর উত্তর সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্ক নির্ভর করেছে ভূরাজনীতির গতি প্রকৃতির উপর। শীতলযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রকে যে ভাবে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রসর মানুষেরা বিবেচনা করতো, গর্বাচভ উত্তর সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সাম্রাজ্র্যবাদ কিংবা সম্প্রসারনবাদের তকমাটি কিছুটা হলেও ম্লান হয়েছে।ষাটের দশকে আমরা দেখেছি দেয়ালে দেয়ালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তরুণদের মনোভাব। দেয়ালের গায়ে পুঁজিবাদী এ'দেশটিকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে "মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক, নিপাত যাক"।ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত দেয়ালে, মিছিলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি যে ভাবে ঘৃণা উদগীরণ হতো, নব্বইয়ের দশক থেকে ক্রমাগত এর তীব্রতা কমে এসেছে। আমার সাথে অনেক বামপন্থী ভাইয়েরা দ্বিমত পোষণ করবেন জানি তবে গভীর ভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং জনমানসকে যারা বিশ্লেষণ করেন তারা কিন্তু দ্বিমত পোষণ করবেন বলে মনে হয়না।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন "মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র" নামের সাথে সাথে বাঙালি মানসে আরও কতো গুলো নাম উচ্চারিত হতো।একাত্তরে রিপাবলিকান সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার তীব্র বিরোধিতা করেছে। শুধু বিরোধিতা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু প্রতিম দেশ ও ন্যাটো জোট সরাসরি পাকিস্তানকে অর্থ ও মারণাস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত্ররাষ্ট্রের বিরোধিতা, অস্ত্র এবং কূটনৈতিক ফ্রন্টে পাকিস্তানকে সহায়তা মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি ছিলো খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ। সেই দগদগে ঘা, এখনও শুকিয়ে যায়নি। তবে সময়ের পরিক্রমায় অর্থনীতি এবং কূটনীতি ক্ষেত্রে যুক্ত্ররাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকার কারণে মুক্তিযুদ্ধপূর্ব, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের সাথে যদি মুক্তিযুদ্ধ উত্তর সময়ের তুলনা করা হয় তাহলে আমরা দেখতে পাই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের মানুষ এবং রাষ্ট্রের সম্পর্ক অভাবিত উন্নয়ন ঘটেছে।
বাংলাদেশে এখনও যুক্তরাষ্ট্রের নাম উচ্চারিত হলে, প্রেসিডেন্ট নিক্সন, পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকার কথা ঘৃণা ভরে উচ্চারিত হয় একই ভাবে শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় উচ্চারিত হয় জর্জ হ্যারিসন, সিনেটর টেড কেনেডির মতো মানুষের নাম।যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের মানুষ এবং রাষ্ট্রের সম্পর্ক শীতল এবং উষ্ণ হয়েছে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক ভিশন এবং কৌশলের উপর ভিত্তি করে। সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রাষ্ট্রটিকে একাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত ঘৃন্য রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি দিয়েছিলো। তবে বাংলাদেশের অনেক বিদ্বান মানুষ যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষোন করলেও, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চার বিষয়ে দ্বিমত করতে পারেননা।গণতন্ত্রের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা বাংলাদেশের উদার গণতান্ত্রিক মানুষেরা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে থাকেন।
বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন, এবং সহায়তা করে অনেক মার্কিন নাগরিক বাংলাদেশের মানুষের কাছে এখনও ভালোবাসার পাত্র হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছেন। এই ভালোবাসা গণত্রন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রতি ব্যক্তির, জনসমাজের ভালোবাসা যা রাজনৈতিক দলের সংকীর্ণ নীতির উর্ধে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ দলের নীতির উর্ধে উঠতে পেরেছিলেন। এ'প্রসংগে কেনেডির ভূমিকা এখনও বাংলাদেশে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়।তিনি যে দলের সিনেটর সেই রিপাবলিকান দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কনেডি বাংলাদেশের মানুষের যৌক্তিক অধিকার এবং স্বাধীনতার পক্ষে নিরলস ভাবে কাজ করে গেছেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির এ ভাই টেড কেনেডি। দীর্ঘদিন সিনেটরের দায়িত্ব পালন করেন।
কেনেডির নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হলো এ'কারণে যুক্তরাষ্ট্র বলতে আমরা সবসময় যুক্ত্ররাষ্ট্রীয় সরকার এবং এর বিদেশনীতিকে বুঝে থাকি। যুক্তরাষ্ট্র মূলত গণতন্ত্র ও মানবাধকার চর্চার একটি উল্লেখযোগ্য দেশ এ'কথাটি আমরা বিস্মৃত হয়ে যাই। দেশটিতে সরকারের নীতির থেকে জনমত সব সময় বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। এই জনমতকে সংহত করতে একাত্তরে অনেকেই কাজ করেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ শ্রদ্ধার সাথে আজও তাদেরকে স্মরণ করে থাকেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন জর্জ হ্যারিসন।বাঙালিদের ওপর মির্মম হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ারে হাজার জনতার সামনে 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' নামে এক কনসার্টের আয়োজন করে তিনি বিশ্ব মিডিয়ায় বিশেষভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তার গানের সুরে বাংলাদেশের অসহায় মানুষের বেদনার আর্তি ফুটে ওঠেছিলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বাক, ব্যক্তি স্বাধীনতার অবারিত চর্চা পৃথিবীর সকল দেশের মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষকেও আকর্ষিত করে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন রাজনীতি, গণতন্ত্র চর্চা, নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে এক করে দেখলে দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র কেমন তার মূল্যায়ন এবং উপসংহারে পৌঁছা খুব কঠিণ।যুক্তরাষ্ট্রকে অভিবাসীর দেশ, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানীর প্রথম সারির দেশ, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় অংশীদার হিসেবে পরিবর্তিত প্রেক্ষিতে বিবেচনা না করে পারা যাবেনা। মনে রাখতে হবে ভূ-রাজনীতি এখন আবর্তিত হয় অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করে। সম্পর্কের যতোই উঠা নামা হোক না কেনো যুক্তরাষ্ট্রকে বাঙালিরা চিরকাল আব্রাহাম লিংকনের মতো গণতন্ত্রের কর্ণধারের দেশ হিসেবে বিবেচনা করে আসছে।বাংলাদেশী অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের সেই চেতনাকে আবার পুনরাবিস্কার করছেন।লিংকন যিনি বিশ্ব থেকে দাস প্রথার মতো অমানবিক প্রথা বিলোপ করেছিলেন তার চেতনাকে বাংলাদেশী অভিবাসীরা শ্রদ্ধা করেন। যুক্তরাষ্ট্র একসময় যেমন সামাজ্যবাদী, আধিপত্যবাদী দেশ হিসেবে পরিচিত ছিলো, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দেশটি এখন মানবতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার রক্ষার দেশ হিসেবে বাঙালি অভিবাসীদের কাছে স্বীকৃত হয়ে ওঠছে।অভিবাসীদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, পরিবর্তিত ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দেশটি ধীরে ধীরে বাংলাদেশীদের কাছে ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রদর্শন করতে সমর্থ হয়েছে।