সপ্তাহান্তের ঘুর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা। ঘূর্ণিঝড় হেলেনের তাণ্ডবে নিহতের সংখ্যা ১৩০ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে শুধু নর্থ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যের বানকম্ব কাউন্টিতেই অন্তত ৩০ জন নিহত হয়েছেন। এই সংখ্যা আরও বাড়তে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। হারিকেন হেলেনের শক্তিমত্তা এতটাই বেশি ছিল যে, স্টেইনহ্যাচি শহরটি মানচিত্র থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে! নর্থ ক্যারোলাইনার অ্যাশভিল কাউন্টির জরুরি সেবা বিষয়ক কর্মকর্তা রায়ান কোল বলেছেন, ‘মনে হলো যেন অসুরীয় তাণ্ডব চলছে। আমরা কেউই আমাদের জীবদ্দশায় এমন ঘূর্ণিঝড় দেখিনি।’ রাজ্য গভর্নর রয় কুপার বলেন, এটি ইতিহাসের অন্যতম ধ্বংসাত্মক বিপর্যয়। পশ্চিম–উত্তর ক্যারোলাইনার যাদের সঙ্গেই আমি কথা বলি, তারা বলেন, এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ কখনো দেখেননি। ১৯টি রাজ্যের অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল মিলে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করছে। ফেডারেল সরকারও তদারকিতে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হেলেন ২৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ফ্লোরিডায় আঘাত হানে। সেখানে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়ে উত্তর দিকে জর্জিয়া, ক্যারোলিনা এবং টেনেসি অঙ্গরাজ্যে আছড়ে পড়ে। রাজ্যগুলোজুড়ে বিদ্যুৎ এবং মোবাইল পরিষেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। গাছ উপড়ে পড়ে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেছে। বিমা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, এই ঘূর্ণিঝড়ে শুধু পানি ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ ও পরিবহন রুটের ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ হবে ১০০ বিলিয়ন ডলার। বিস্তারিত ক্ষতির পরিমাণ এখনই নিরূপণ করা সম্ভব নয়। অনেক বাসিন্দা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরে নিজেদের ধ্বংস হওয়া বাড়ি ছাড়া কিছুই দেখতে পাননি। এখনো অন্তত ১ হাজার মানুষ আত্মীয়স্বজনদের খুঁজে পাচ্ছেন না বলে জানা গেছে। আমেরিকান রেড ক্রস জানিয়েছে, তারা দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্যগুলোতে ১৪০ টিরও বেশি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। প্রায় ২ হাজার মানুষ সেগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। অ্যাশভিল কাউন্টির ম্যানেজার এভ্রিল পিন্ডার জানিয়েছেন, রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে জরুরি খাবার এবং পানীয় জল সরবরাহের জন্য অনুরোধ করেছেন। ফেডারেল ইমারজেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি (এফইএমএ) জানিয়েছে, ছয় ঘণ্টার মধ্যে হেলেন হারিকেনে রূপ নেয়। ন্যাশনাল হারিকেন সেন্টারের (এনএইচসি) তথ্য অনুযায়ী, হেলেনের প্রভাবে ফ্লোরিডা উপকূলের কোথাও কোথাও ১৫ ফুট বা তার বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানা হারিকেনগুলোর মধ্যে শক্তির বিবেচনায় হেলেন ১৪ তম। এই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে স্থলভাগেই ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৪২০ মাইল পর্যন্ত গতিতে বাতাস বয়ে গেছে। এর আগে ২০১৭ সালে হারিকেন আইডা এবং ১৯৯৬ সালে হারিকেন ওপালের সময় ঘণ্টায় ৪৬০ মাইল গতিতে বাতাস বইতে দেখা যায়। ঝড় আসার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের উপকূলীয় অনেক শহর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল বাসিন্দাদের। ঝড়ের হুমকিতে থাকা শহরগুলোর এই তালিকায় ছিল স্টেইনহ্যাচি শহরের নামও।
ফ্লোরিডার যে শহরগুলোর ওপর দিয়ে ঝড়টি বয়ে গেছে তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্টেইনহ্যাচি শহর। ১০ থেকে ১৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস সহ হারিকেন হেলেন প্রায় ২২৫ কিলোমিটার বেগে এসে এই শহরে আঘাত হানে। স্টেইনহ্যাচি শহরটি মানচিত্র থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে!
ফ্লোরিডার রাজধানী শহর তালাহাসি থেকে ৯০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত স্টেইনহ্যাচি শহরে আনুমানিক ৫০০ লোকের বসবাস। ঝড় আসার আগেই শহর থেকে তাঁদের সরিয়ে নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। ঝড় থেমে যাওয়ার পর বাসিন্দাদের কেউ কেউ ফিরে এসে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছেন। কারণ তাঁদের পরিচিত শহরের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। চারদিকে শুধু ধ্বংসের ছবি। অনেকেই বলছেন, মানচিত্র থেকেই মুছে গেছে তাঁদের প্রিয় শহরটি। এখন পর্যন্ত এই ঝড়ে ১১৯ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে মার্কিন সংবাদ মাধ্যমগুলো। তবে নিখোঁজ রয়েছেন আরও অসংখ্য। তাই মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। বিভিন্ন শহরের বিদ্যুৎ লাইনগুলোও উড়ে গেছে। ফলে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন হাজার হাজার মানুষ। ফ্লোরিডা ছাড়াও জর্জিয়া, টেনেসি এবং নর্থ ও সাউথ ক্যারোলিনার বিস্তীর্ণ এলাকায় এই ঝড়ের প্রভাব পড়েছে। কোথাও কোথাও ১৫ ফুটেরও বেশি উঁচু জলোচ্ছ্বাস দেখা গেছে। সরকারিভাবে ঝড়ের ক্ষয়-ক্ষতি সম্পর্কে এখনো কোনো হিসেব মেলানো যায়নি। তবে আর কোনো ঝড়ের আশঙ্কা না থাকায় পরিস্থিতির দ্রুত উত্তরণ হবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ।