কমলা নাকি ট্রাম্প, কাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট দেখতে চান চীনা জনগণ

ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ২২:৪৭

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর বেশি দিন বাকি নেই। আগামী ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে এখন শেষ পর্যায়ের প্রচারে ব্যস্ত দুই প্রার্থী ডেমোক্রেটিক পার্টির কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের এই নির্বাচনের দিকে সারা বিশ্ব নজর রাখছে। সবার আগ্রহ, কে হতে যাচ্ছেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কমলা নাকি ট্রাম্প?

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরেক পরাশক্তি চীনের দ্বন্দ্ব তীব্র হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে চীনা জনগণের গভীর আগ্রহ যেমন আছে, তেমনি রয়েছে উদ্বেগও। তাঁরাও এই নির্বাচনের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখছেন।

নির্বাচনে জিতে যিনিই হোয়াইট হাউসে যান না কেন, নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের আগমনে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কী ঘটতে পারে, তা নিয়ে চীনা নাগরিকেরা উদ্বিগ্ন।

এ প্রসঙ্গে জিয়াং নামের এক চীনা নাগরিক বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা কেউ যুদ্ধ দেখতে চাই না।’

চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের রিতান পার্ক। এখানে সম্প্রতি অন্য জ্যেষ্ঠ চীনা নাগরিকদের সঙ্গে নাচ শিখতে এসেছিলেন জিয়াং। তাঁরা এখানে নিয়মিতই জড়ো হন। পার্কটির অবস্থান বেইজিংয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসভবন থেকে মাত্র কয়েক শ মিটার দূরে।

পার্কে আসা ব্যক্তিদের ভাবনায় নতুন নাচের মুদ্রা শেখার বিষয়টি যেমন আছে, তেমনি আছে আসন্ন মার্কিন নির্বাচনের প্রসঙ্গ।
এমন একসময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হচ্ছে, যখন দুই পরাশক্তি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তাইওয়ান, বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক নানা ইস্যুতে উত্তেজনা চলছে।

জিয়াংয়ের বয়স ষাটের ঘরে। তিনি বলেন, ‘চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কে টানাপোড়েন বাড়ছে দেখে আমি চিন্তিত। আমরা শান্তি চাই।’
বেইজিংয়ের পার্কটিতে এই আলাপ শুনতে লোকজনের ভিড় জমে যায়। জমায়েত হওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নিজেদের পুরো নাম বলতে নারাজ।

তবে ব্যাপারটি এমন নয় যে চীনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিষয় নিয়ে কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা আছে। এ নিয়ে কথা বলাই যায়। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। তাঁরা যদি নিজ দেশের নেতাকে নিয়ে সমালোচনা করেন, তাহলে ঝামেলায় পড়তে পারেন। তবুও তাঁরা কেন যেন নিজেদের পুরো নাম বলতে চান না।

পার্কে জড়ো হওয়া চীনা লোকজন বলেন, তাঁরা যুদ্ধ নিয়ে উদ্বিগ্ন। বেইজিং-ওয়াশিংটনের মধ্যকার সম্ভাব্য সংঘাত নিয়ে তাঁদের যেমন উদ্বেগ আছে, তেমনি মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ নিয়েও তাঁরা চিন্তিত।

পার্কে আসা মেং নামের এক চীনা নাগরিক এই উদ্বেগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বলেন, তাঁর আশা, আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প জয়ী হবেন।

মেংয়ের বয়স সত্তরের কোঠায়। তিনি বলেন, ট্রাম্প আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকাকালে চীনের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। তবে তিনি যুদ্ধ বাধাতে চাননি।

মেং আরও বলেন, বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে একাধিক যুদ্ধ বাধিয়েছেন। তাই অনেক সাধারণ মানুষ তাঁকে অপছন্দ করেন। বাইডেন ইউক্রেন যুদ্ধে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। আর এই যুদ্ধের জেরে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

পার্কে কিছু মেয়েও এসে ছিলেন। তাঁদের একজন বলেন, ট্রাম্প বিতর্কে বলেছেন, তিনি ক্ষমতা গ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন।

এই চীনা নাগরিক আরও বলেন, কমলা সম্পর্কে তিনি খুব কমই জানেন। তবে তাঁরা মনে করেন, তিনি বাইডেনের মতো একই পথের অনুসারী। তিনি যুদ্ধ সমর্থন করবেন।

চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে ঠিক একই রকমের প্রচারণা চলছে।

মধ্যপ্রাচ্যবাসীদের ‘আরব ভাই’ হিসেবে বর্ণনা করে থাকে চীন। এই প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে আলোচনার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বেইজিং। একই সঙ্গে ইসরায়েলকে দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছে চীন।

অন্যদিকে ইউক্রেন বিষয়ে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, তাঁরা গঠনমূলক ভূমিকা পালন করছেন। আর ওয়াশিংটন তার স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করছে।

বেশির ভাগ বিশ্লেষক মনে করেন, আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে কে হোয়াইট হাউসে যাবেন, সে বিষয়ে বেইজিংয়ের কোনো পছন্দ-অপছন্দ নেই।

তবে অনেকেই একমত হবেন যে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা সম্পর্কে চীনা জনগণ ও দেশটির নেতারা তেমন কিছু ‘জানেন’ না।

কিন্তু কেউ কেউ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে তাইওয়ানের মতো বড় ইস্যু এলে এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের চেয়ে কমলার অবস্থান হবে বেশি স্থিতিশীল।

বেইজিংয়ের পার্কটিতে আসা চার বছর বয়সী এক সন্তানের পিতা বলেন, ‘আমি ট্রাম্পকে পছন্দ করি না। আমি মনে করি না যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ভালো ভবিষ্যৎ আছে। এই সম্পর্কে অনেক সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে যেমন আছে বৈশ্বিক অর্থনীতির বিষয়, তেমনি আছে তাইওয়ান সমস্যা।’

এই বাবার আশঙ্কা, তাইওয়ান নিয়ে দুই দেশের বিরোধ শেষ পর্যন্ত সংঘাতে গড়াতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমি এটা (সংঘাত) চাই না। আমি চাই না, আমার ছেলে (চীনা) সামরিক বাহিনীতে যাক।’

স্বশাসিত তাইওয়ানকে নিজের অংশ বলে দাবি করে চীন। চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছেন, মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে তাইওয়ানের পুনর্মিলন অনিবার্য। এ জন্য প্রয়োজনে বলপ্রয়োগে অঙ্গীকার করেছেন তিনি।

চীনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি তারা ‘এক চীন নীতি’ অনুসরণ করে আসছে। তারা তাইওয়ানকে আলাদা রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়নি। তবে তা সত্ত্বেও বিশ্বে তাইওয়ানের সবচেয়ে বড় সমর্থক যুক্তরাষ্ট্র।

আইনের আওতায় তাইওয়ানকে প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, তাইওয়ানকে সামরিকভাবে রক্ষা করবে যুক্তরাষ্ট্র।

তবে তাইওয়ান প্রশ্নে কমলা এমন ‘চরম’ কিছু বলেননি। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে তিনি সব জাতির নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের কথা বলেন।

লুসি নামের এক চীনা শিক্ষার্থীর ভাষ্য, যুক্তরাষ্ট্রে একজন নারীকে (কমলা হ্যারিস) প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে দেখে তিনি উচ্ছ্বসিত
লুসি নামের এক চীনা শিক্ষার্থীর ভাষ্য, যুক্তরাষ্ট্রে একজন নারীকে (কমলা হ্যারিস) প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে দেখে তিনি উচ্ছ্বসিতছবি: এএফপি
অন্যদিকে তাইওয়ান বিষয়ে ট্রাম্পের ভাবনায় কূটনীতির প্রাধান্য নেই। বরং তাঁর প্রাধান্যে রয়েছে একটি চুক্তি। এই চুক্তির আওতায় তাইওয়ানকে সুরক্ষা দেওয়ার বিনিময়ে তাইপের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার পক্ষে তিনি। ইতিমধ্যে তিনি অর্থ দেওয়ার জন্য তাইপের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন।

সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে চিপ ব্যবসা কেড়ে নিয়েছে তাইওয়ান। তার মানে, যুক্তরাষ্ট্র কতটা বোকা? আর তাইওয়ান অত্যন্ত ধনী। তাই তাইওয়ানের উচিত তার প্রতিরক্ষার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থ দেওয়া।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিয়ে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের একটি বিষয় হলো, তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট হলে চীনা পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন।

বেইজিংয়ের পার্কটিতে আসা ১৭ বছর বয়সী চীনা নাগরিক লুসির আশা, পড়াশোনা করার জন্য একদিন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন। সেখানে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর ইউনিভার্সাল স্টুডিও দেখতে যাওয়ার স্বপ্ন তাঁর।

লুসি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে দেখে তিনি উচ্ছ্বসিত। লিঙ্গসমতার দিক দিয়ে কমলার প্রার্থিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তাঁকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে দেখাটা উৎসাহব্যাঞ্জক বিষয়।

লুসি অবশ্য দুই দেশের মধ্যকার তীব্র প্রতিযোগিতার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি মনে করেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো করার সর্বোত্তম উপায় হলো, দুই দেশের জনগণের মধ্যে বিনিময় তথা মেলবন্ধন আরও বাড়ানো।