যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বড় মেয়ে ইভাঙ্কা ট্রাম্প নিজের পরিণত বয়সের পুরোটাই বাবার সঙ্গে নানা কাজে কাটিয়েছেন। ট্রাম্প যখন আবাসন খাতের মোগল ছিলেন, তখন ইভাঙ্কা তাঁর পরবর্তী হোটেলের নকশা করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ট্রাম্প যখন টিভিতে অনুষ্ঠান করতেন, তখন তিনি তাঁর টেলিভিশন বোর্ডরুমের সদস্য ছিলেন। ট্রাম্প যখন প্রথমবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলেন, তখন তিনি তাঁর প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৭ সালে ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমবার ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন ইভাঙ্কা হোয়াইট হাউসের ওয়েস্ট উইংয়ে কাজ করেছেন।
কিন্তু ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ইভাঙ্কা ওয়াশিংটন ছেড়ে যান, বাবার চাকরিও ছেড়ে দেন। ২৩ বছর বয়স থেকে ওয়াশিংটনে থাকার পর এবার তিনি প্রথমবারের মতো শহরটি ছেড়েছেন। এভাবেই রাজনীতির সঙ্গে পাঠ চুকিয়ে ফেলেছেন ইভাঙ্কা ট্রাম্প। তিনি নিজেও এর আগে বলেছেন, তিনি আর রাজনীতিতে ফিরছেন না।
২০২২ সালে ট্রাম্প তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দেন। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে ইভাঙ্কা বলেছিলেন, ‘আমি আমার বাবাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। তবে এখন আমি আমার ছোট শিশুদের এবং পরিবার হিসেবে আমরা যে একটি ব্যক্তিগত জীবন তৈরি করছি, সেটাকেই অগ্রাধিকার দিতে চাইছি। আমি রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা করছি না।’
২০২৪ সালে ট্রাম্পের বিজয়ের পরও ইভাঙ্কা নিজের অবস্থানে অটল রয়েছেন বলে জানিয়েছে তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্র। ওই সূত্রগুলো বলেছে, ইভাঙ্কা ও তাঁর স্বামী জ্যারেড কুশনার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মিয়ামি শহরে একান্ত ব্যক্তিগত জীবন কাটাতে চাইছেন। চার বছর ধরে তাঁরা সেখানে বসবাস করছেন। এ সময় তাঁদের তেমন একটা জনসমক্ষে দেখা যায়নি।
একজন সাবেক ও পুনরায় নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কোনো সহকারীর এভাবে দূরে সরে দাঁড়ানোটা নাটকীয়। তবে হোয়াইট হাউসে চার বছর অতি ব্যস্ত সময় কাটিয়ে ইভাঙ্কার এভাবে সরে দাঁড়ানোটা কিন্তু ইচ্ছাকৃত।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তাঁর গ্রহণ করা কিছু সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে না পারায় ইভাঙ্কা সব সময় নানা ধরনের সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। তখন তিনি নিউইয়র্কে নিজেদের উদার মতাদর্শে বিশ্বাসী বন্ধুমহলে কিছুটা অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েছিলেন। নৈতিকতাবিষয়ক প্রশ্নের মুখে তাঁকে নিজের নামে দাঁড় করানো মোটামুটিভাবে সফল একটি কাপড়ের ব্র্যান্ড বন্ধ করতে হয়েছিল। কিন্তু ইভাঙ্কার রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর অর্থ হলো, তাঁর বাবা এখন আর তাঁর বস নন। এখন নতুন জীবনধারায় নতুন পথ তৈরি করছেন তিনি।
গত জুলাই মাসে ‘দ্য লেক্স ফ্রিডম্যান পডকাস্ট’-এ দীর্ঘ তিন ঘণ্টা কথা বলেছেন ইভাঙ্কা। এতে তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতি বেশ অন্ধকার একটি জগৎ। সেখানে অনেক অন্ধকার ও বিপুল নেতিবাচক বিষয় আছে। মানুষ হিসেবে আমার কাছে যা কিছু ভালো মনে হয়, সেটার সঙ্গে এটা আলসেই মেলে না।’
নিজের ওয়াশিংটনের জীবনের দিকে ইঙ্গিত করে ট্রাম্পের বড় মেয়ে বলেন, ‘আপনি জানেন, এটা (রাজনীতি) আসলেই একটি দুরূহ কাজ। তাই এতে অংশ না নেওয়াটা আমার পরিবার ও আমার জন্য ভালো মনে হচ্ছে।’
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবারের একজন অতিপরিচিত সদস্য হিসেবে ইভাঙ্কা কতটা ব্যক্তিগত জীবন কাটাতে পারবেন, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। ট্রাম্পের অনেক সমর্থকের কাছে তিনি ভীষণ প্রিয়। অন্যদিকে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের অনেক নিন্দুকের লক্ষ্যবস্তুও তিনি।
ইভাঙ্কা সম্পর্কে জানেন এমন একটি সূত্র বলেছে, তিনি এখনো তাঁর বাবার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ। তিনি তাঁর সঙ্গে নিয়মিত কথা বলেন। আরও কয়েকটি সূত্র সিএনএনকে বলেছে, দৃশ্যপটের বাইরে থেকে তিনি তাঁকে নানা বিষয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে উপদেশ দেওয়া অব্যাহত রাখবেন।
ইভাঙ্কার দীর্ঘদিনের বন্ধু ম্যাগি কর্ডিশও ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে হোয়াইট হাউসের ওয়েস্ট উইংয়ে এক বছর কাজ করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘ট্রাম্পের জন্য ইভাঙ্কা একটি বিশ্বস্ত কণ্ঠস্বর। সেদিক থেকে তিনি বাবার একজন অনানুষ্ঠানিক উপদেষ্টাও।’
চার বছর কাজ করার সময় হোয়াইট হাউসের কর্মী ও উপদেষ্টাদের সমীহ অর্জন করেছিলেন ইভাঙ্কা। তাঁর সাফল্যকে তাঁরা বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতেন এবং প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন। ওই চার বছরে তাঁর সাফল্যকে জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য তাঁদের বিশেষ প্রচেষ্টা ছিল। অন্যদিকে তুলনামূলক কম জনপ্রিয় বিভিন্ন নীতি থেকে তিনি নিজেকে দূরে রাখতেন।
ওয়েস্ট উইংয়ের চার বছর মেয়াদে ইভাঙ্কা নিজের ভাবমূর্তি খুব সাবধানে গড়ে তুলেছিলেন। ফৌজদারি বিচার সংস্কার, মানব পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই এবং দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো কম বিতর্কিত বিষয়ের দিকে নিজের মনোযোগ বাড়িয়েছিলেন।
ওই সব বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে ট্রাম্পের এক প্রতিনিধি সিএনএনকে বলেছেন, হোয়াইট হাউসের কর্ম প্রচেষ্টায় ইভাঙ্কা গর্বের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং প্রশাসনের সাফল্য এগিয়ে নিয়েছেন।
সূত্রগুলো বলছে, ট্রাম্পের এবারের মেয়াদে বাবার প্রতি ইভাঙ্কার উপদেশ অনেকটা রাডারের নিচে থাকার মতো বিষয় হবে।
ইভাঙ্কার চিন্তার সঙ্গে পরিচিত একটি সূত্র বলেছে, এবার যদি তিনি তাঁর বাবার দ্বিতীয় মেয়াদে প্রভাব বিস্তার করতে চান, ‘তা কখনো জনসমক্ষে আসবে না’। অর্থাৎ আড়ালেই কাজ করবেন ইভাঙ্কা।
জামাতা কুশনারও এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের নতুন প্রশাসনে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তবে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক কাজে তিনি বাইরে থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টার কাজ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ, কুশনারের সঙ্গে অঞ্চলটির নেতাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে অঞ্চলটির সঙ্গে তাঁর নিজেরও বড় ধরনের আর্থিক স্বার্থ জড়িত।
নবনির্বাচিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখনো যে নিজ পরিবারের সদস্যদের প্রতি বিশেষ আস্থা রাখেন, সেটার প্রমাণ হলো জ্যারেড কুশনারের বাবা চার্লস কুশনারকে তিনি ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মনোনয়ন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।