প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এ বছরের শেষে অথবা সামনের বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন হবে। কিন্তু এখন থেকেই স্বাধীনতাবিরোধী, ক্ষমতালোভী, জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনকারী, আর পরগাছা গোষ্ঠীর সরব তৎপরতা শুরু হয়েছে। এদের লক্ষ্য ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পেছনের দরজা দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করা; গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা। এরা লুণ্ঠন করা অর্থে দেশে-বিদেশে ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী এবং বিবৃতিজীবী নিয়োগ দিয়েছে; আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এদের মিথ্যাচারে বিভ্রান্ত হবেন না।’
বর্তমান সরকারের চার বছরপূর্তি উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। জনগণের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনে বিশ^াসী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনুরোধ, সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়- এমন কোনো উদ্ভট ধারণাকে প্রশ্রয় দেবেন না; ইন্ধন জোগাবেন না। আমরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা করছি। নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য বাংলাদেশে এই প্রথম একটি আইন পাস হয়েছে। সেই আইনের আওতায় সার্চ কমিটি করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে আর্থিক স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে কমিশনকে সব ধরনের সহায়তা সরকার দিয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জনগণের দল, জনগণের শান্তিতে বিশ^াসী, জনগণের শক্তিতে বিশ^াসী। জনগণ ভোট দিয়ে বিজয়ী করলে আওয়ামী লীগ দেশ গড়ার দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখবে। যদি বিজয়ী না করে, তা হলে আমরা জনগণের কাতারে চলে যাব। তবে যেখানেই থাকি, আমরা জনগণের সেবা করে যাব। কিন্তু ষড়যন্ত্র করে কেউ যাতে জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে না পারে, সেদিকে সবার সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে, কেউ যেন আন্দোলনের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করে মানুষের জানমাল ও জীবিকার ক্ষতি করতে না পারে, সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের দেশ এগিয়েছে অনেক। তবে আরও এগিয়ে নিতে হবে। একটি উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ অর্জন আমাদের লক্ষ্য। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পর আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য হলো স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নানা অনুষঙ্গ ধারণ করে আমরা তরুণদের প্রশিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি।’
স্মার্ট দেশ গড়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একটি সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আসুন, স্মার্ট দেশ গড়ার মাধ্যমে একটি সুখী-সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলে আমরা তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করি। এ দেশের সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটাই।’ এ সময় সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছাড়পত্র কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
২৫ মিনিট ধরে দেওয়া বক্তব্যের শুরুতে সরকার গঠনের চার বছরপূর্তি উপলক্ষে দেশবাসী ও দেশের বাইরে অবস্থানরত প্রবাসীদের শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে খ্রিস্টীয় নতুন বছরের শুভেচ্ছাও জানান। পরে তিনি বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও নির্যাতিত মা বোন ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা স্মরণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শাহাদাতবরণকারীদের আত্মার মাগফিরাত এবং শান্তি কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী।
সরকারের অবদানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে একটানা ১৪ বছর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। এই ১৪ বছরে আমরা দেশ এবং দেশের জনগণকে কী দিতে পেরেছি, তার বিচার-বিশ্লেষণ আপনারা করবেন।’
তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে আমরা যখন সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখনো বিশ^ব্যাপী মন্দাবস্থা চলছিল। চালসহ নিত্যপ্রণ্যের দাম ছিল আকাশচুম্বী। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ছিল নিম্নমুখী। বিদ্যুতের অভাবে দিনের পর দিন লোডশেডিং চলত। গ্যাসের অভাবে শিল্পকারখানার মালিকরা যেমন হাহাকার করতেন, তেমনি চুলা জ¦লত না মানুষের বাড়িতে। সারসহ কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্য এবং জ¦ালানি তেলের অভাবে কৃষকের নাভিশ^াস উঠেছিল। এমনি এক অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে আমরা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিই। নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে আমরা রূপকল্প-২০২১ প্রণয়ন করি এবং জনগণের সামনে তুলে ধরি। জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠনের পর সেই ইশতেহারের আলোকে আমরা আশু করণীয়, স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করি।’
প্রাধনমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার সুফল জনগণ আজ পেতে শুরু করেছেন। আজ দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুতের আওতায়। নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্ধিত চাহিদা মেটানোর জন্য আমরা এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করে এলএনজি আমদানির ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রত্যন্ত গ্রামে আজ গ্যাসের চূলায় রান্না হয়। আমরা নানা প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করেছি। গত ২৮ ডিসেম্বর মেট্রোরেল উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে আমরা যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরেকটি মাইলফলক স্পর্শ করেছি। কিছুদিনের মধ্যে চট্টগ্রামে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পাতাল সড়কপথ- বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধনের মাধ্যমে আরেকটি মাইলফলক স্থাপিত হবে। পাবনার ঈশ^রদীর রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। আমরা ২০১৮ সালের মে মাসে মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করেছি।’
বিএনপির শাসনামলের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০১ সালের প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত জোট আবার ক্ষমতায় আসে। বিএনপি-জামায়াতের সরকারের সময় অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে পড়ে। মেয়াদ শেষে নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে স্বাভাবিক ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার বানিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার ষড়যন্ত্র করে। দলীয় রাষ্ট্রপতিকেই প্রধান উপদেষ্টার পদ দিয়ে সরকার গঠন করে ৬ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে প্রহসনের উদ্যোগ নেয়। জনগণ তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এমনি এক অরাজক পরিস্থিতির মুখে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। তারাও জনগণের প্রত্যাশা পূরণে শুধু ব্যর্থই হয়নি, নানা বিতর্কিত কর্মকা-ে জড়িয়ে সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কালিমালিপ্ত করে। তবে শেষ পর্যন্ত সেই সরকার ছবিসহ একটি সুষ্ঠু ভোটার তালিকা তৈরি এবং স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সসহ নির্বাচনী সংস্কার সম্পন্ন করে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।’
করোনা মহামারীতে সরকারের ভূমিকা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এক গভীর অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল। কিন্তু আপনাদের সহায়তায় এবং আমাদের সরকারের সময়মতো উদ্যোগ গ্রহণের ফলে আমরা খুব ভালোভাইে সেই মহামারী মোকাবিলা করতে পেরেছি। টিকা পাওয়ার যোগ্য শতভাগ মানুষকে বিনামূল্যে টিকা দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতিতে মহামারীর প্রভাব মোকাবিলায় ২৮টি প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছি। গার্মেন্টসসহ অন্যান্য শিল্পকারখানার শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিশ্চিত করা হয়েছে। ৫০ লাখ প্রান্তিক মানুষকে দুই দফায় আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।’
মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ সরকারের অবদান তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা কয়েকটি পণ্য বেশি দামে কিনে স্বল্পদামে সীমিত আয়ের মানুষের মধ্যে বিতরণ করছি। এক কোটি পরিবার টিসিবির ফেয়ার প্রাইজ কার্ডের মাধ্যমে ৩০ টাকা কেজি দরে চাল ও সাশ্রয়ীমূল্যে ভোজ্যতেল, ডাল ও চিনি ক্রয় করতে পারছেন। ৫০ লাখ পরিবার ১৫ টাকা কেজি দরে মাসে ৩০ কেজি চাল কিনতে পারছেন। অসহায় মানুষদের ভিজিডি ও ভিজিএফের মাধ্যমে ৩০ কেজি করে চাল প্রতিমাসে বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। তৃতীয় লিঙ্গ, বেদে, মান্তা, দলিত, হরিজন, কুষ্ঠরোগীসহ সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ করেছি আমরা।’
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবদানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘসহ দুই ডজনেরও বেশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সংগঠনে বাংলাদেশ সক্রিয় সদস্য। গত অক্টোবরে পঞ্চমবারের মতো বিপুল ভোটে বাংলাদেশ জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে স্থলসীমানা চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের বন্দি জীবনের অবসান হয়েছে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমানার শান্তিপূর্ণ মীমাংসার মাধ্যমে আমরা বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সামুদ্রিক এলাকার ওপর সার্বভৌম অধিকার অর্জন করেছি। আমরা ১২ লাখের মতো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বিশে^ মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি।’