ঢাকায় নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করার পর একযোগে আন্দোলন

নিজস্ব সংবাদদাতা
  ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:৫৬

সরকারবিরোধী আন্দোলনে আগে রাজধানী ঢাকায় নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করে জনমত সৃষ্টির দিকে মনোযোগ দিয়েছে বিএনপি। ঢাকা প্রস্তুত হওয়ার পর সারাদেশ থেকে একযোগে দ্রুত সরকার পতনের এক দফার চূড়ান্ত আন্দোলনে যেতে চায় দলটি। বিএনপি নেতাদের ভাষ্য, ক্ষমতাসীনদের নানা বাধার পরও গত কয়েক মাসে তাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন সফল হয়েছে। এতে সারাদেশে নেতাকর্মী ও সাধারণ সমর্থকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে চূড়ান্ত আন্দোলনের মানসিকতা। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এখন চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগের বিভাগীয় গণসমাবেশ এবং ১১ জানুয়ারি গণঅবস্থান কর্মসূচিতে ঢাকার নেতাকর্মীদের প্রস্তুতি মনঃপুত হয়নি দলের নীতিনির্ধারকদের। তাই একযোগে চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আগে ঢাকায় ক্ষেত্র প্রস্তুতেই এখন মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। এর জন্য আগামী দিনে কী কর্মসূচি নেওয়া যায়, তা নিয়ে গত বৃহস্পতিবার দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, ‘এই সরকারের অধীনে কোনো কিছু নিরাপদ না, তা দেশের মানুষ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছে। এই সরকারের জনপ্রিয়তা কতটুকু তা-ও ক্ষমতাসীনরা ভালো করেই জানে। ফলে তারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছে। এ ধরনের উপসর্গ রাজনীতিতে আগে
কোনোদিন দেখা যায়নি। গত তিন-চার মাস ধরে এই সরকারের অন্যায়-অত্যাচারের পরও দেশের মানুষ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় প্রশ্ন হচ্ছে চূড়ান্ত আন্দোলন কবে? আমি বলব, চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হয়েছে। তবে আন্দোলনের ফল কবে আসবে, সেটা বলতে পারি না। যতক্ষণ পর্যন্ত ফল না হবে, ততক্ষণ চূড়ান্ত আন্দোলন প্রমাণ হয় না। এই আন্দোলনের গতি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে। একটা সময় সফলতার মুখ দেখবে।’
বিএনপি নেতাদের সূত্রে জানা যায়, নতুন বছরে বিএনপির পরিকল্পনা ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হওয়ায় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব আগামী মার্চ মাসে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার কথা ভাবছিলেন। এ নিয়ে চলতি মাসে দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা মহানগরের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ শেষ করেই চূড়ান্ত আন্দোলনের যাওয়ার পক্ষে নীতিনির্ধারকরা।
জানা গেছে, সম্প্রতি ঢাকা মহানগর বিএনপি, অঙ্গসহযোগী সংগঠনের মহানগর কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে দলের শীর্ষ নেতারা দ্রুত কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। গত ২ জানুয়ারি বিএনপির আন্দোলনের ১০ দফা ও রাষ্ট্র ‘মেরামতের’ ২৭ দফা রূপরেখার ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণের আলোচনায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন মার্চে কঠোর আন্দোলনের ইঙ্গিত দেন। নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সময় বেশি নেই, অপেক্ষা করা যাবে না। আন্দোলনের জন্য ফেব্রুয়ারি, বেশি হলে মার্চের মাঝামাঝি নেতাকর্মীদের জন্য পরীক্ষা।
বিএনপির অন্য নেতারা মনে করছেন, মার্চে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হতে পারে। বাড়তে পারে ডলারের দাম। ওই সময় গরম বাড়ায় বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়বে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে চাহিদামতো জ্বালানি আমদানি করতে না পারলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির অবনতি হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যও বাড়তে থাকবে। এতে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। তখন জোরালো কর্মসূচি দিলে মানুষের ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে আন্দোলন সফল করা যাবে।
যদিও চূড়ান্ত আন্দোলনের নামে সময়ক্ষেপণে এর সাফল্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন বিএনপির অনেকে। দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, যেভাবে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাতে চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়া আগেই সরকার বিএনপিকে দুর্বল করে দেবে। কারণ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। সে অনুযায়ী অক্টোবরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। মার্চে রমজান মাস শুরু। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে ঈদ। এরপর বর্ষাকাল ও কোরবানির ঈদ উদযাপনের মাধ্যমে জুলাই মাস চলে আসবে। ফলে এই গোটা সময় তেমন কোনো কর্মসূচি পালন করা যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ নেতা মার্চেই আগেই চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার পক্ষে মত দিচ্ছেন।
এই অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলের অভ্যন্তরীণ বেশকিছু সমস্যা, সন্দেহসহ বেশকিছু বিষয় তুলে আনা হয়।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আমানের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসের গ্রেপ্তার এবং নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশের অভিযানসহ নানা প্রসঙ্গ নিয়ে গত বৃহস্পতিবারের বৈঠকে আলোচনা হয়। একইসঙ্গে আলোচনা হয় ১৫ সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত জোট নিয়েও। সূত্র জানায়, বৈঠকে গত ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশের আগে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানসহ বেশ কয়েকজন নেতার বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এক অনুষ্ঠানে আমান বলেছিলেন, ১০ ডিসেম্বরের পরে দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়। ওই বক্তব্যের পরে সরকার ভয় পেয়ে যায়। যদিও এই বক্তব্যের পর আমানকে ডেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ভর্ৎসনা করেছিলেন।
বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উদ্দেশ করে এক নেতা বলেন, গ্রেপ্তার হয়েছি কিনা তখনও জানতাম না। কিন্তু ডিবি অফিসে তার কাছে গল্পের ছলে জানতে চাওয়া হয়, আমরা বসে যাব কিনা? যতবারই বলেছি, তাদের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেই। থাকলে আমি জানতাম। অন্যান্য বিভাগীয় গণসমাবেশের মতোই এটা একটি গণসমাবেশ। কিন্তু ডিবি পুলিশ কোনো অবস্থায় তা বিশ্বাস করতে চায়নি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই নেতা বলেন, ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় মুখ ফসকে একটি বক্তব্য দিয়েছিলাম। সেই ঘটনায় আমার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। তাহলে আমানের কাছে কেন ব্যাখ্যা চাওয়া হবে না? এরপর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিষয়টি মহাসচিবকে দেখতে বলেন। বৈঠকে ওই নেতা আরও বলেন, সরকারের লোকজন সঙ্গে নিয়ে তো আর সরকারবিরোধী আন্দোলন করা যাবে না। যার কথাকে কেন্দ্র করে সবাই গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাকেই আবার কারাগারে নেওয়ার আগে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এতে সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।
স্থায়ী কমিটির এই বৈঠকের আগে গত বুধবার নয়াপল্টনে গণঅবস্থান কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান সভাপতিত্ব করেননি। আগের দিন বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, গণঅবস্থান কর্মসূচিতে অন্যান্যদের সঙ্গে পরিচালনায় থাকবেন আমান। এরপর থেকে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া গণঅবস্থানে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির নেতাকর্মীর উপস্থিতি দেখতে চেয়েছিলেন তারেক রহমান। সে অনুযায়ী বিশেষ অতিথি হিসেবে মির্জা আব্বাস যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন দলের কেন্দ্রীয় একজন নেতা লাইভে তারেক রহমানকে বিস্তারিত দেখান। তখন ঢাকা মহানগরের উত্তরের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম, যা নিয়ে অন্য নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা গেছে।
এদিকে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়া এবং ১৫ সংগঠনের সমন্বয়ে নতুন জোট করা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হয়। বৈঠকে তারেক রহমানের কাছে স্থায়ী কমিটির একজন নেতা জানতে চান, এটা কেমন হলো, আমরা জোট ভেঙে দিলাম, আবার গুলশান কার্যালয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবমুখী ১৫ সংগঠন নিয়ে একটি জোট গঠন করলাম! এটা কেমন বার্তা গেল? এ সময় স্থায়ী কমিটির আরেক নেতা বলেন, একটি বিষয়ে ফোকাস করা দরকার। ছোট ছোট দল নিয়ে গুলশান অফিসে একটি জোট হয়েছে। আসলে এগুলো কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এ জন্যই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ৫৪ দলের ৫৪টি ঘোড়ার ডিম পাড়ার মতো মন্তব্য করার সুযোগ পেয়েছেন। এটা (জোট) কারা করছে, কীভাবে করছে? এর একটা বিহিত হওয়া প্রয়োজন।
এই জোট গঠনের সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ছিলেন। যদিও একজন নেতা বলেন, আমান উল্লাহ আমানের তত্ত্বাবধানেই জোট হয়েছে। একজন নেতা জানতে চান, আমানকে দলের অথরিটি কে দিয়েছে?
বিষয়টি নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন নেতা ও ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ঢাকা মহানগরের সমস্যা সমাধান এবং দলের সন্দেহভাজন নেতাদের দূরে রেখে আন্দোলনের পরিকল্পনা করলেই সফলতা আসবে। ২০১৪ সালের আন্দোলন ঢাকার নেতাদের জন্য ব্যর্থ হয়েছে। তাই এবার ঢাকাকে ঠিক করেই আন্দোলনে যেতে হবে।