দেশের কল্যাণ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, আখিরাত ও বিশ্বশান্তি কামনা করে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। ইজতেমায় আগত মুসল্লিরা গতকাল সকাল থেকেই চোখ-কান খোলা রেখে মাইকের দিকে মনোযোগ রাখেন- কখন মোনাজাত শুরু হবে। সকাল ৯টা ৫৬ মিনিটে মাইকে ভেসে এলো কয়েক লাখ মুসল্লির কাক্সিক্ষত তাবলিগ মারকাজের কাকরাইল মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ জোবায়ের আহমদের কণ্ঠ- সবাই দোয়া পড়ি। এর ১ মিনিট পর শুরু হয় দোয়া। প্রথমে আরবিতে ১০ মিনিট, পরে বাংলায় ১৩ মিনিট মোট ২৩ মিনিট মোনাজাতে তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি আমাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করিয়া দেন। হে আল্লাহ, এই জমিন ও এই আসমানের মালিক আপনি, আপনিই আমাদের হেফাজত করতে পারবেন। আমরা কার কাছে যাব, আপনি তো আমাদের রব, আপনিই আমাদের সব। হে আল্লাহ সারা দুনিয়ার আলেমকে আপনি হেফাজত করেন। দ্বীনের মেহনতে যারা বেরিয়েছে তাদের জান-মালের হেফাজত করেন। দিনের মেহনত করার তৌফিক দান করেন। সমস্ত বাধা-বিপত্তি থেকে রক্ষা করেন। হে আল্লাহ, এই ইজতেমাকে আপনি কবুল করেন। আপনি আমাদের ইমানকে মজবুত করিয়া দেন। আমরা তওবা করতেছি আর অন্যায় কাজ করব না। আমাদের দোয়া কবুল করেন। আপনি আমাদের ক্ষমা না করলে আমরা কার কাছে যাব। আমরা তো ইয়াতিম, আমাদের গুনাহর দিকে না তাকিয়ে আমাদের দোয়া কবুল করেন।’ মাওলানা জুবায়েরের কথাগুলো লাখো মুসল্লির হৃদয়ে যেন ছুঁয়ে যাচ্ছিল। সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চেয়ে অনেকেই অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। আবেগাপ্লুুত লাখো লাখো মুসল্লির কণ্ঠে এ সময় ‘আমিন, আমিন’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়। আবেগঘন আখেরি মোনাজাতে ধনী-গরিব, সব শ্রেণি-পেশার লাখ লাখ মুসল্লি শরিক হয়ে পরওয়ারদেগার আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে দোয়া করেন। আখেরি মোনাজাতে প্রায় ৪০ লাখ মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন বলে ধারণা করছেন আয়োজক কমিটি।
তাবলিগ জামাতের বিবদমান বিরোধের কারণে এবারও বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে আলাদাভাবে। আলমি শুরার তত্ত্বাবধানে গতকাল প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে। আগামী ২০ জানুয়ারি শুরু হবে দ্বিতীয় পর্ব। এ পর্বে অংশ নেবেন সাদ কান্ধলভির অনুসারীরা। আগামী ২২ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমা। এদিকে মোনাজাতে অংশ নিতে গত শনিবার থেকেই টঙ্গীর ইজতেমা মাঠের দিকে মুসল্লিদের ঢল নামে। জায়গা পাবেন না, এমন আশঙ্কায় তারা অবস্থান নেন ইজতেমার মাঠসংলগ্ন সড়ক-মহাসড়কে। অলিগলি এবং রাস্তা থেকে মহাসড়ক, সড়কে থেমে থাকা বাস কিংবা তুরাগ নদের দুই তীরে ভিড়িয়ে রাখা নৌকা- যত দূর চোখ যায়, বিভিন্ন বয়সী শুধু মানুষ আর মানুষ। বাস, ট্রাক, ট্রেনে, হেঁটে বিভিন্নভাবে মোনাজাতে যোগ দেন মুসল্লিরা। মুসল্লিদের চলাচলের সুবিধার্থে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কসহ আশপাশের কয়েকটি সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় জেলা প্রশাসন। যান চলাচল বন্ধের কারণে হেঁটেই ইজতেমাস্থলে জড়ো হন মুসল্লিরা।
মোনাজাতে ভিআইপি : গতকাল আখেরি মোনাজাতে সরাসরি শরিক হন ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল। এ ছাড়া রাষ্ট্র্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষ শরিক হন মোনাজাতে।
ফিরতিতে বিড়ম্বনা : আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পর একসঙ্গে লাখ লাখ মানুষ ফিরতে শুরু করলে সর্বত্র মানবজটের সৃষ্টি হয়। টঙ্গী স্টেশনে ফিরতি যাত্রীদের জন্য অপেক্ষমান ট্রেনগুলোতে উঠতে মানুষের জীবনবাজির লড়াই ছিল উদ্বেগজনক। ট্রেনের ভিতরে জায়গা না পেয়ে ছাদে ও দরজা-জানালায় ঝুলে শত শত মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরতে দেখা যায়। একপর্যায়ে মানুষের জন্য ট্রেন দেখা যাচ্ছিল না। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও আশুলিয়া সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় মুসল্লিদের বিড়ম্বনা ও কষ্টের সীমা ছিল না। এদিকে, একশ্রেণির পরিবহন শ্রমিক মুসল্লি ও সাধারণ যাত্রীদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে পকেট কাটার প্রতিযোগিতায় নামে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগ, ট্রাফিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কোথাও সক্রিয় থাকতে দেখা যায়নি।
স্বাস্থ্যসেবা : গত তিন দিনে ইজতেমায় আগত প্রায় ৬ হাজার মুসল্লিকে জরুরি চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গতকাল পর্যন্ত ২১ জন ভর্তি ও ১১ জনকে ঢামেক হাসপাতাল রেফার করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম।
ময়দানে ময়লার ভাগাড় : বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের ভিতরে ও বাইরে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনার স্তূপ মুসল্লিদের অতিষ্ঠ করে তোলে। প্রথম পর্বের পুরো সময়ই এ কটু অবস্থা বিরাজমান ছিল। গাজীপুর সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি নজরদারিতে না রাখায় ইজতেমায় আগত মুসল্লিরা চরম দুর্ভোগের শিকার হন। গাজীপুর সিটি মেয়র (ভারপ্রাপ্ত) মো. আসাদুর রহমান কিরণ এ বিষয়ে বলেন, আখেরি মোনাজাত শেষে মুসল্লিরা ময়দান ত্যাগ করলে ভিতরের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা হবে। ৬০০ পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রস্তুত রাখা হয়েছে ময়দান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে।
আট মুসল্লির মৃত্যু : টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আরও এক মসুল্লির মৃত্যু হয়েছে। মৃত আনিসুর রহমান (৭১) গতকাল ভোর সোয়া ৬টার দিকে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। তিনি ঢাকার বংশাল আলাউদ্দিন রোডের মৃত ছমির উদ্দিনের ছেলে। প্রথম পর্বে এ নিয়ে ইজতেমা ময়দানে আট মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে।
বিনামূল্যে পানি বিতরণ : গতকাল ইজতেমা ময়দানের পাশে টঙ্গী বাজার এলাকা আইআরআই রোডের মাথায় ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম তাঁর ব?্যক্তিগত উদ্যোগে মুসল্লিদের মধ্যে বিনামূল্যে পানি বিতরণ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আজাহার বেপারী ও হারুন মাদবর প্রমুখ।
দুই সহস্রাধিক জামাত তৈরি : বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন দেশে তাবলিগের কাজে বের হতে এবার দুই সহস্রাধিক জামাত তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে দেশীয় জামাত হয়েছে প্রায় দুই হাজার এবং প্রায় ৮০০ বিদেশি জামাত। এসব জামাতে কেউ কেউ এক চিল্লা, দুই চিল্লা, তিন চিল্লা, ছয় চিল্লা ও এক বছরের চিল্লা এমনকি আজীবন চিল্লার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে।
সাদপন্থিদের কাছে ইজতেমা মাঠ হস্তান্তর : মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীদের ইজতেমা আগামী ২০ জানুয়ারি শুরু হবে। গাজীপুর জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু দুটি পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলমান, তাই সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মঙ্গলবার (আগামীকাল) সকালে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম পক্ষের কাছ থেকে মাঠ বুঝে নেব। এরপর ওই দিনই বেলা ১১টার মধ্যে দ্বিতীয় পক্ষের কাছে বুঝিয়ে দেব।
তবে আমাদের কার্যক্রম শুরু হবে সোমবার (আজ) সকাল থেকে।’ এদিকে মাঠে প্রবেশের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে মাওলানা সাদ অনুসারীর শীর্ষস্থানীয় মুরব্বি মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের হাতে সময় খুব কম। আমাদের সাথীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এরই মধ্যে মাঠের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। অনেক বিদেশি মেহমানও এসে পড়েছেন। প্রশাসন তাদের কথামতো নির্দিষ্ট সময় মাঠ বুঝিয়ে দিলেও আমাদের আরও কাজ করতে হবে। সময়মতো মাঠ বুঝে পেলেই হয়।’