যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ২০২৪-এর শুরুতে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হওয়ার ব্যাপারে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। এই নির্বাচনে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করবে কি না, সেজন্য কী করণীয় এসব বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনি প্রক্রিয়া নিয়েও কথা বলেছেন। প্রায় ৩২ ঘণ্টার হাই প্রোফাইল ও ঝটিকা সফরে সরকারের পাঁচ জন মন্ত্রী ও উপদেষ্টা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন এই মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তা। তিনি স্পষ্ট জানান, যুক্তরাষ্ট্র কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে নয়, বরং মানসম্পন্ন নির্বাচনি প্রক্রিয়া, জনগণের অধিকারই যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ডোনাল্ড লু বলেন, নিষেধাজ্ঞার পর মানবাধিকার সমুন্নত রেখে র্যাব আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও সন্ত্রাসবাদ দমনে ভালো কাজ করছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও কমেছে।
অন্যদিকে লুর সঙ্গে আলোচনার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গঠনমূলক পরামর্শ গ্রহণ করা হবে। যদি কোনো দুর্বলতা থাকে, সেটি আমরা দূর করব।
ডোনাল্ড লু দুই দিনের সফরে শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় আসেন। এরপর গতকাল রবিবার মধ্যরাত পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারের প্রতিনিধি, কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেন তিনি। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে প্রাতঃরাশ বৈঠকের মাধ্যমে ডোনাল্ড লুর দিনের কার্যক্রম শুরু হয়। দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী ছাড়াও প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিকালে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে আলোচনা করেন। দুপুরে মধ্যাহ্নভোজে আলোচনা করেন কয়েক জন সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কূটনীতিক ও বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে। সন্ধ্যায় গুলশানে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে নাগরিক সমাজের আরেকটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কথা বলেন। এছাড়া গুলশানে সলিডারিটি সেন্টারে শ্রম অধিকার, কর্ম পরিবেশ ও নিরাপত্তা ইস্যুতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করেন তিনি।
গতকাল দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিনটি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ডোনাল্ড লু বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব দৃঢ় করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশও তার হাত সম্প্রসারণ করেছে। আমি এখানে এসেছি দুই দেশের বন্ধুত্বকে শক্তিশালী করতে, যখন বর্তমান বিশ্ব শান্তি ও ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আমাদের বিশদ আলোচনা হয়েছে। আমরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা যদি কোনো সমস্যা দেখি, তখন আমরা বিষয়টি উত্থাপন করি এবং আমরা পরামর্শ দিতে পারি। আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখায় বিশ্বাস করি এবং বাংলাদেশের মতো অংশীদারদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, র্যাবের বিষয়ে ভালো আলোচনা হয়েছে। আপনারা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে দেখবেন বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা কমানোর ক্ষেত্রে র্যাবের অসাধারণ অগ্রগতির কথা স্বীকার করা হয়েছে। আমরাও এই অগ্রগতির বিষয়টি স্বীকার করি। এটি একটি অসাধারণ কাজ। এতে প্রমাণ হয় যে মানবাধিকার সমুন্নত রেখে র্যাব আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও সন্ত্রাসবাদ দমনে ভালো কাজ করছে।
তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে সুবিধা পাওয়ার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জিএসপি পুনর্বহালে কংগ্রেস যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে প্রথম তালিকায় বাংলাদেশ থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি নিয়ে ডোনাল্ড লু বলেন, আইপিএস নিয়ে আমাদের চমৎকার আলোচনা হয়েছে। এটি কোনো ক্লাব নয়, বরং একটি কৌশল।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের মধ্যে গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের পুরোনো বন্ধু। আমরা সামনের ৫০ বছর কীভাবে সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, সেটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের গঠনমূলক পরামর্শ গ্রহণ করা হবে। আমাদের মধ্যে যদি কোনো কিছু নিয়ে প্রশ্ন থাকে, তবে আমরা আলোচনা করে সমাধান করব। এর নমুনা আমরা দেখিয়েছি। আমাদের যদি কোনো দুর্বলতা থাকে, সেটি আমরা দূর করব।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, আমরাও অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। আমার দল আওয়ামী লীগ সব সময় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় এসেছে। ব্যালটের মাধ্যমে এসেছে, বুলেটের মাধ্যমে নয়।
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, গত বছরের মতো এবারও আমাদের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, আমরা একটি সময়সূচি ধরে চলমান মেকানিজমের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্পর্ককে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করব। তিনি জানান, ঢাকা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে আইপিএস নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
গতকাল বিকালে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীর সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করেন ডোনাল্ড লু। নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, র্যাবের কার্যক্রম, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, মানবাধিকার ইস্যুতে তাদের মধ্যে কথা হয় বলে জানা যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, র্যাবে চলমান সংস্কারকাজ অব্যাহত থাকলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেন, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার জটিল প্রক্রিয়া হলেও ভবিষ্যতে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। লু মনে করেন, র্যাব ইস্যুতে বাংলাদেশ সঠিক প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলেই বিষয়টির মীমাংসা হবে।
মন্ত্রী জানান, ঢাকায় গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপিকে বিভাগীয় গণসমাবেশ করতে দেওয়ায় ডোনাল্ড লু সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আসন্ন নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ সব দল শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি চালাবে। নির্বাচনের তিন মাস আগে নির্বাচন কমিশন প্রশাসনের দায়িত্ব বুঝে নেবে। শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে আলোচনা করেন ডোনাল্ড লু। এখানে সব দলের অংশগ্রহণে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে করণীয় নিয়ে আলোচনা করেন ও পরামর্শ নেন। গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, নাগরিকদের অধিকার যে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার সেটি তুলে ধরেন লু। অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, ড. শাম্মী আহমেদ, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ড. দেলোয়ার হোসেন, ড. লাইলুফার ইয়াসমিন প্রমুখ মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন।