রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে চলছে চরম নৈরাজ্য। মামলা-হামলা, টাকার বিনিময়ে মামলা, টাকার বিনিময়ে মামলা থেকে অব্যাহতি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুট তুচ্ছ ঘটনায় মারামারি খুনাখুনি যখন তখন সংঘর্ষ বিক্ষোভ, ইচ্ছে হলেই রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। স্কুল-কলেজে হুটহাট সংঘর্ষে প্রায়শই কোনো না কোনো রাস্তা বন্ধের ঘটনা ঘটছে। সব মিলিয়ে এসব ঘটনায় অচল হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকার যান চলাচল। বিভিন্ন এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে পড়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে বহু মানুষকে। ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকরা রাস্তা অবরোধ করেছে; পুরান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী, কবি নজরুল কলেজ ও যাত্রাবাড়ির ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ছাত্ররা ঘোষণা দিয়ে যাত্রাবাড়ি-মৃধাবাড়িতে সংঘাত-ত্রিমুখি সংঘর্ষের মাধ্যমে গোটা এলাকাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করে। ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে সংঘর্ষের ঘটনার পর আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকায় ছয় প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। যাত্রাবাড়ির ওই রণক্ষেত্রের যারা ভুক্তভোগী তাদের অভিযোগ সাধারণ ছাত্রদের ভিতরে মিশে গিয়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সংঘর্ষ বাঁধানোর সৃষ্টি করে।
সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা, ডিবি, এসবি, এনএসআইসহ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। তারা ‘ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষ’ সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে পারলো না? তারা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ঝামেলা জিইয়ে রাখতে সঠিক তথ্য দিচ্ছেন না?
‘অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন কয়েকদিন আগে শাহবাগে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে সারাদেশের গ্রামগঞ্জ ঘুরে ঘুরে মানুষকে ঢাকায় একত্রিত করার চেষ্টা করেছে। তারা জনে জনে টাকা দিয়ে বাস ভাড়া করে গ্রাম-গঞ্জ থেকে হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় নিয়ে এলো। গ্রামের সহজ সরল মানুষকে বিনা সুধে ঋণ দেয়ার লোভ দেখিয়ে প্রতারিত করলো। আর গোয়েন্দা সংস্থা কিছুই জানতে পারলো না? ঢাকায় একদিকে বিভিন্ন সড়কে ব্যাটারি চালিত রিকসা চালকের নামে শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীদের অবরোধ, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তিনটি কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে মিশে ঘোষণা দিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষ, শাহবাগে হাজার হাজার মানুষকে গ্রাম থেকে এনে একত্রিত করা, একটি গণমাধ্যম অফিসে আগের দিন গরু জবেহ করে পিকনিক ও পরের দিন প্রতিবাদে গণমিছিল; এতোগুলো ঘটনার ঠেকানোর লক্ষ্যে আইন শৃংখলা বাহিনীর কোনো প্রকার পূর্বপ্রস্তুতিও দেখা যায়নি।
পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ছালেহ উদ্দিন বলেছেন, যাত্রাবাড়ীর মৃধাবাড়ি এলাকার ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে পরিকল্পিতভাবে হামলা করা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসীরা ছাত্রবেশে হামলা চালিয়ে লুটপাট করেছে। আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি করতে এই হামলা ও কোটি টাকার মালামাল লুটপাট হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে, মামলা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে পুর্ব পরিকল্পিত হামলা হলে আগাম সেটাকে ঠেকিয়ে দেয়া হলো না কেন? আইন শৃংখলা বাহিনী কি আসলেই জানে না, নাকি তারাও অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপাকে ফেলার নানামুখি এই ষড়যন্ত্রের অংশ? ছাত্র জনতা কোনটা ধরে নেবে?
ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপাকে ফেলতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃস্টির লক্ষে গ্রাম থেকে গ্রামের আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের গরীব কর্মীদের ঢাকায় এসে রিকসা চালানোর পরামর্শ দেন। যাতে যে কোনো সময় হাসিনা ডাক দিলে তারা সরকারের রিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসেন। সারাদেশের শ্রমিক লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে ব্যাটারি চালিত রিকসার চালক হয়ে যান। ঢাকা হয়ে উঠে রিকসার নগরী, যানজট ও দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। ১৯ নভেম্বর হাইকোট ৩ দিনের মধ্যে মহানগরের প্রধান সড়কে ব্যাটারি চালিত রিকসা চলাচল বন্ধ করার ঘোষণা দেয়। অতপর শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা ব্যাটারি চালিত রিকসার চালক বেশে প্রতিদিন ঢাকার রাস্তা বন্ধ করে অবরোধ করেন এবং যানবাহন ভাংচুর করেন। অথচ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করে রাষ্ট্রপক্ষ। গতকাল ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নূর মুহাম্মদ আজমী জানান, ঢাকা মহানগর এলাকায় তিনদিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধের আদেশে স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাসকো) দিয়েছেন চেম্বার আদালত। আপিল বিভাগের চেম্বার জজ মো. রেজাউল হক এ আদেশ দেন। এর ফলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচলে আর বাধা থাকল না।
ঘোষণা দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলা : যাত্রাবাড়ি এলাকা গতকাল রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। ঘোষণা পাল্টা ঘোষণা দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলা ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। সোমবার দুপুর ১টার দিকে এ সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় মোল্লা কলেজের গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে হামলা, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ার, কম্পিউটার-ল্যাপটপ ভাঙচুর করে কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা। কলেজটির বিভিন্ন সামগ্রী ও সরঞ্জাম নিয়ে যেতে দেখা যায় তাদের। এ সময় এলাকাটি রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে ৮ জন আহত হয়েছেন।
সংঘর্ষে কলেজের আশপাশের সড়কগুলোতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনাস্থলে আইনশৃংখলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য রয়েছেন। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। এর আগে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা ও ভাঙচুর চালানোর প্রতিবাদে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়ে এ বিক্ষোভ করেন। তাদের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন। পরে দুপর ১২টার পর তাদের একটা অংশ যাত্রাবাড়ীতে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ অভিমুখে রওনা দেন।
উল্লেখ্য, এর আগে গত রোববার ভুল চিকিৎসায় অভিজিৎ হাওলাদার নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর অভিযোগের জের ধরে পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা।
ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ থেকে চলতি বছর উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন অভিজিৎ হাওলাদার। তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত সোমবার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
শাহবাগে বাসভর্তি মানুষ : বিনা সুদে ঋণ দেওয়ার প্রলোভনে রাজধানীর শাহবাগে সারাদেশ থেকে মানুষ এনে জড়ো করা হয়। বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল অর্থ ফেরত নিয়ে আসবেন ড. ইউনূস, সেই টাকায় বিনা সুদে এক লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত লোন দেওয়া হবে। বিনা সুদের সেই লোন পেতে আবেদন করতে হবে নির্ধারিত ফরমে। প্রাথমিকভাবে এক হাজার টাকা দিয়ে শাহবাগে আসতে হবে। যত বেশি টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন, তত বেশি মিলবে ঋণ।
এমন প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে আসেন নিরীহ মানুষ। তাদের হাতে ‘অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের লিফলেট। এতে সংগঠনের আহ্বায়ক আ ব ম মোস্তফা আমীনের ছবি ও পরিচয় দেওয়া আছে। এ ছাড়া সমাবেশের অনুমতি সম্বলিত ডিএমমি কমিশনারের ভুয়া পত্রও তাদের কাছে পাওয়া গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর রফিকুল ইসলাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে জানান, ফরওয়ার্ড পার্টি নামে একটি সংগঠনের প্রলোভনে পড়ে এই মানুষগুলো ঢাকায় এসেছে। খবর পেয়ে প্রক্টরিয়াল টিম নেতাগোছের সন্দেহভাজন ১৫ জনকে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করেছে। কয়েকজন ভুক্তোভোগী বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে ঘুরে জনে জনে টাকা দিয়ে গ্রাম-গঞ্জ থেকে হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় নিয়ে এলো। আর গোয়েন্দা সংস্থা কিছুই জানে না? কোনো প্রকার পূর্বপ্রস্তুতিও দেখলাম না! তারা কি আসলেই জানে না, নাকি তারাও এই ষড়যন্ত্রের অংশ? আমরা কোনটা ধরে নিব?
বুটেক্স-পলিটেকনিক সংঘর্ষ : ২৪ নভেম্বর গভীর রাতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অবে টেক্সটাইল (বুটেক্স) ও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত অসংক্য শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। রোববার রাত সাড়ে ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।