বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের পর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ঋণ বাংলাদেশের প্রয়োজনের তুলনায় খুব বেশি নয়। তবে সার্বিক বিবেচনায় এটি দেশের অর্থনীতিতে স্বস্তির জায়গা এনে দেবে। তাদের মতে, এ ঋণের প্রভাবের দিক থেকে অর্থের চেয়ে সংস্কার বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে ঋণপত্র খোলাসহ বিদেশি ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়বে। সরকারের অর্থ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার কথা থাকলেও সোমবার মার্কিন ডলারের বিপরীতে আইএমএফের স্পেশাল ড্রইং রাইটস (এসডিআর) অবমূল্যায়ন হওয়ার কারণে এখন মোট ঋণের পরিমাণ ২০ কোটি ডলার বেড়েছে।
গত সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় অনুষ্ঠিত আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকে এই ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। গতকাল মঙ্গলবার আইএমএফের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি জানানো হয়। ঋণের প্রথম কিস্তি আগামী ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পাওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। মোট সাত কিস্তিতে এই ঋণ দেওয়া হবে। ঋণের প্রথম কিস্তির পরিমাণ হবে ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। অবশিষ্ট ছয় কিস্তির প্রতিটিতে ৭০ কোটি ৪ লাখ ডলার করে ঋণ ছাড় করা হবে। ঋণের শেষ কিস্তি আসবে ২০২৬ সালে। বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে ঋণের গড় সুদহার ২ দশমিক ২ শতাংশ।
বাংলাদেশের বিশিষ্টজনরা জানিয়েছেন, এই ঋণের প্রভাব কতটা পড়বে তা বুঝতে কিছুটা সময় লাগবে। অর্থনীতির প্রভাব আইএমএফের চূড়ান্ত সুনির্দিষ্ট শর্তের ওপর নির্ভর করছে। আইএসএফের শর্তগুলো বুঝতে এখনো সপ্তাহখানেক সময় লাগবে। তবে আমরা শুধু কিছু টাকা পাব। দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রথম কিস্তি ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ছাড় হবে। আইএমএফের অর্থায়ন আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় খুব বেশি টাকা নয়। গত সাত মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ৯০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। সেখানে আমরা পাচ্ছি মাত্র ৪৭০ কোটি ডলার। কাজেই টাকাটা বড় বিষয় নয়। টাকাটা শুধু দেশের অর্থনীতিকে সহায়তা করবে। অর্থনীতিকে কিছুটা চাঙ্গা করবে। প্রভাবের প্রসঙ্গ এলে বলতে হবে যে এখানে অর্থের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কর্মসূচি।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘মূলত শর্তের মধ্যে আইএমএফের একটা ম্যাট্রিক্স থাকবে যে কোনো খাতে কী সংস্কার করতে হবে। মোটা দাগে তারা যে সংস্কারগুলোর কথা বলেছে তা হচ্ছে-সরকারের ব্যয় কমাতে হবে, আর্থিক খাত সংস্কার করতে হবে, জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে, ঋণখেলাপি কমাতে হবে প্রভৃতি। এখানে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলো কী, সেটা এখনো আমরা জানি না। তাদের এই ঋণ মূলত ৪২ মাস তথা ২০২৬ সাল পর্যন্ত চলমান থাকবে।’
জাহিদ হোসেন বলেন, ‘তবে বর্তমানে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি একটা চাপের মধ্যে আছে। চাপের মধ্যে আইএমএফের সঙ্গে ৪২ মাস মেয়াদি একটি কর্মসূচির দিকে যাচ্ছি আমরা। এটি ম্যাক্রো ম্যানেজমেন্টের জন্য সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। আগামী ২০২৩ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে, প্রতিবছর যদি অন্তত দুটি কিস্তি পাওয়া যায়, তা হলে প্রতিবছর ১০০ কোটি ডলারের মতো একটা অর্থের জোগানের জায়গা এখান থেকে তৈরি হচ্ছে। যদিও আমাদের সার্বিক ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি অনেক বেশি। সে তুলনায় এটা মোটা কোনো অঙ্ক নয়। তবে শূন্যের চেয়ে তো ভালো। সেদিক থেকে এটি একটি স্বস্তির জায়গা।’
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ আইএমএফের ঋণ পাচ্ছে তার মানে দাঁড়াচ্ছে দেশের আর্থিক দুর্বলতা দূর হয়ে এর ভিত্তি মজবুত হয়েছে। বিদেশি বড় ব্যাংক এখন বাংলাদেশকে আরও ভালো চোখে দেখবে। কারণ বাংলাদেশ আইএমএফের একটা প্রোগ্রামের মধ্যে আছে। এখন সেই ব্যাংক একটা ঋণপত্র খুলতে দ্বিধাবোধ করবে না। সূত্র জানিয়েছে, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল চিকিৎসার জন্য এখন সিঙ্গাপুর অবস্থান করছেন। দেশে ফিরে আগামী শুক্রবার আইএমএফের ঋণ নিয়ে ব্রিফিং করতে পারেন।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ আইএমএফের ঋণ কী পরিমাণ পেল, তা টাকার অংকের বিষয় না। ৪৭০ কোটি ডলারের এ ঋণ বাংলাদেশের আড়াই মাসের রেমিট্যান্সের সমান। আইএমএফ যে ঋণ দিচ্ছে, তা দিয়ে মাত্র ১৫ দিনের আমদানি খরচ মেটানো যাবে।
অর্থ বিভাগ সূত্র আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি ডলার আলোচনা শুরু করেছিল বটে; কিন্তু সোমবার মার্কিন ডলারের বিপরীতে আইএমএফের স্পেশাল ড্রইং রাইটস (এসডিআর) অবমূল্যায়ন হওয়ার কারণে মোট ঋণের পরিমাণ ২০ কোটি ডলার বেড়েছে। প্রসঙ্গত, স্পেশাল ড্রইং রাইটস (এসডিআর) হলো সদস্য দেশগুলোর অন্যান্য রিজার্ভ সম্পদের পরিপূরক একটি রিজার্ভ ব্যবস্থা, যা সুদসংবলিত আন্তর্জাতিক রিজার্ভ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। মুদ্রার একটি ঝুড়ি হিসেবে এসডিআরকে সজ্ঞায়িত করে। মার্কিন ডলার, ইউরো, চীনা ইউয়ান, জাপানি ইয়েন এবং ব্রিটিশ পাউন্ড এসডিআর মুদ্রা বা বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আইএমএফের এসডিআর ৫০ শতাংশ মার্কিন ডলারে রয়েছে।
আইএমএফের বিভিন্ন শর্ত সম্পর্কে অর্থ বিভাগের ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রথম কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো পূর্বশর্ত নাই। সরকার এখন জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছে নিজের প্রয়োজনে। মূলত প্রথম কিস্তি পেতে কোনো পূর্বশর্তও নেই। গতকাল মঙ্গলবার বিদ্যুতের যে যে বাড়ানো হয়েছে, এর সঙ্গে প্রথম কিস্তির ঋণের কোনো সম্পর্ক নেই।
অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, আইএমএফের বাংলাদেশের ঋণের অনুমোদনের ছয়টি বিষয় ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে আইএমএফের বোর্ড অনুমোদনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচ কার্যদিবস লাগবে। সেটা বাংলাদেশে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে সাত দিন সময় লাগবে। অনুমোদনের ঋণ প্রস্তাবের ছয়টি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে আইএমএফের স্টাফ মিশনের মূল্যায়ন, ঋণের ব্যাক গ্রাউন্ড নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের চিঠি ও মেমোরেন্ডাম অব ইকোনমিক অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল পলিসি, যার মধ্যে থাকবে সরকারের প্রতিশ্রুতিগুলো।
জানা যায়, আর্থিত খাতের শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন, সার্বিক ভর্তুুকি কমিয়ে আনা, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি স্থাপন এবং বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াসহ প্রায় বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে এই ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে ঋণের যে কোনো কিস্তি আটকে দিতে পারে আইএমএফ।
আইএমএফ জানিয়েছে, এই ঋণের মধ্যে ‘বর্ধিত ঋণ সুবিধা’ (ইসিএফ) ও ‘এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি’র (ইএফএফ) অধীনে প্রায় ৩৩০ কোটি ডলার এবং নবগঠিত ‘রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি’র (আরএসএফ) অধীনে অবশিষ্ট ১৪০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। এ ফান্ড থেকে এশিয়ার কোনো দেশ এ প্রথম অর্থ পাচ্ছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তনি মনসিও সায়েহ বলেন, বাংলাদেশকে ৪২ মাসের জন্য নানা কর্মসূচির আওতায় এ ঋণ দেওয়া হয়েছে। এ ঋণ বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়তা করবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার যে সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তা বাস্তবায়নেও সহায়তা করবে এই ঋণ। বৃহত্তর সামাজিক ও উন্নয়নমূলক ব্যয় সক্ষম করার জন্য আর্থিক খাত তৈরিতে ফোকাস করবে আইএমএফ ঋণ। আর্থিক খাত উন্নত ও শক্তিশালীকরণ, নীতিকাঠামো আধুনিকীকরণ এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা তৈরিতে সহায়তা করবে এ ঋণ। তিনি বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে আরও টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সরকারকে তার উচ্চাভিলাষী সংস্কার কার্যক্রমের গতি বাড়াতে হবে। এখন রাজস্ব খাতে সংস্কার করলে বাংলাদেশ সামাজিক খাত, উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যয় বৃদ্ধি করতে পারবে।
অন্যদিকে, ঋণ প্রস্তাবটি অনুমোদনের পর গণমাধ্যমে গতকাল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘আইএমএফ ঋণ অনুমোদনের মাধ্যমে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক এলাকাগুলো শক্ত ভিতের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে এবং অন্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো আছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।’