গত বছরের ১০ ডিসেম্বর দলের ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ ঘিরে বিএনপিতে যে সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে তা আমলে নিয়েছে দলীয় হাইকমান্ড। সন্দেহভাজন নেতাদের তালিকা করে তাদের কর্মকাণ্ড নজরদারির জন্য দলটির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের একজনকে দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে বিষয়টি নিয়ে কেউই মুখ খুলতে চাইছেন না।
অন্যদিকে ভবিষ্যতে উকিল আব্দুস সাত্তারদের নিয়েও সতর্ক বিএনপি। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির কিছু নেতা হয়তো সরকারের ফাঁদে পা দিতে পারে এ নিয়েও উদ্বেগ আছে দলের ভেতরে।
অগোছালো সাংগঠনিক প্রক্রিয়া, সামঞ্জস্যহীন কর্মসূচি! সব মিলিয়ে বিএনপির অভাবের সংসারে সন্দেহ অবিশ্বাস থাকাটা স্বাভাবিক। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপি’র যদি সমঝোতা না হয় সেক্ষেত্রে উকিল আব্দুস সাত্তারের মতো শতাধিক উদাহরণ তৈরি হতে পারে।
দলীয় সূত্র জানায়, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকার গণসমাবেশে নিয়ে যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়। সমাবেশের স্থান নিয়ে বিএনপি ও সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। পুলিশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দিলেও বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশের ব্যাপারে অনড় অবস্থানে ছিল। এরপর ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষের পর দলীয় কার্যালয়ে পুলিশ অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি আব্দুল কাদির ভুইয়া জুয়েলসহ সাড়ে চার শতাধিক নেতাকর্মী।
পরদিন রাতে উত্তরার বাসা থেকে গ্রেফতার হন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও শাজাহানপুর বাসা থেকে গ্রেফতার হন স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। এরপর গোলাপবাগ মাঠে অনুমতি নিয়ে ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ করে বিএনপি।
সমাবেশের পর থেকে বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তরের নেতাদের অবস্থান নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ৭ ডিসেম্বর গ্রেফতারের পরদিন জামিন পান আমানউল্লাহ আমান। আমান জামিন পেলেও মামলার এজাহারে নাম না থাকলেও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ও আব্বাস জামিন না পাওয়ায় খোদ দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়।
এছাড়া ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষের পর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশে ব্যর্থ হন দলের মহাসচিব নিজে। পুলিশি বাধায় ঢুকতে না পেরে তিনি একাই দলীয় কার্যালয়ের সামনে প্রায় তিন ঘণ্টা অবস্থান করেন। ঢাকা মহানগর ও কেন্দ্রের এতো নেতাকর্মী থাকতে মহাসচিবকে সেদিন কেন একা অবস্থান করতে হয়েছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
এছাড়া ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশে ঢাকার বাইরে থেকে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী যোগ দিলেও মহানগরের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়।
ওই কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে আমানউল্লাহ আমানের বক্তব্য নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হওয়া ও গ্রেফতারের পরদিনই তার জামিন হওয়ায় নেতাকর্মীদের সন্দেহের তীর যেতে শুরু করে তার দিকে। এছাড়া জ্যেষ্ঠ নেতারা জেলে যাওয়ার পর নামসর্বস্ব ১৫ দল ও সংগঠন নিয়ে জোট গঠনের উদ্যোগে তাকে নিয়ে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
বিএনপি মহাসচিব জামিনের পর তার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আমানউল্লাহ আমানকে নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করেন দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা। তিনি ছাড়াও মহানগরের আরও কয়েকজন নেতার অবস্থান নিয়ে আলোচনা হয় ওই বৈঠকে। গত মাসের শেষভাগে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির সভায় ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে মহানগরের নেতারা কে কোথায় ছিলেন বা তাদের ভূমিকা কী ছিল তা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হয়। সেখানে মহানগর নেতাদের অবস্থান নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে দলটির নীতি নির্ধারকরা সন্দেহভাজন নেতাদের নজরদারির জন্য তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। যার প্রধান করা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে।
১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ ঘিরে ঢাকা মহানগর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নেতাকর্মীদের মধ্যে যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে তা যদি সত্যি প্রমাণিত হয় তাহলে দোষী নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে গিয়ে প্রয়োজনে ঢাকা মহানগর দুই শাখার কমিটি নতুন করে গঠনের চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে।
সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সভাপতি/আহ্বায়ক হিসেবে নানামুখী আলোচনা রয়েছে। এই কমিটিতে যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম নীরব সভাপতি/আহ্বায়ক হতে পারেন এবং সাধারণ সম্পাদক/সদস্য সচিব হিসেবে শোনা যাচ্ছে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির বর্তমান সদস্য সচিব আমিনুল হকের নাম। দলীয় অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সম্ভাব্য নতুন কমিটিতে সাইফুল ইসলাম নীরবকে সভাপতি/আহ্বায়ক এবং তাবিথ আউয়ালকে সদস্যসচিব বা সাধারণ সম্পাদক করা হতে পারে।
আমরা কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন এবং সতর্ক। যদিও এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার কৌশলও দলের আছে। বিএনপি থেকে আগেও অনেক বড় তারকা গেছেন কিন্তু বিএনপির তাতে কিছু যায়-আসেনি। সামনেও এমন হলে শূন্যস্থান পূরণের কৌশল এখন আমাদের জানা আছে।
অন্যদিকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার নতুন কমিটির জন্য মির্জা আব্বাসের বলয় থেকে আলোচনায় আছেন মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব ও দক্ষিণের বর্তমান কমিটির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার বলয় থেকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নতুন সম্ভাব্য কমিটিতে আলোচনায় আছে নবী উল্লাহ নবী এবং ইশরাক হোসেনের নাম। এছাড়া ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির শীর্ষ পদে লন্ডন ঘনিষ্ঠ হিসেবে যুবদলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্নার নামও শোনা যাচ্ছে।
দলের অন্য একটি সূত্রের দাবি, ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ ঘিরে নেতাকর্মীদের মধ্যে যে সন্দেহ অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে বিশেষ করে ঢাকা মহানগর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই। পদযাত্রা কর্মসূচির মাধ্যমে ঢাকা মহানগর বিএনপি তাদের সেই সংকট কাটিয়ে উঠেছে। চলমান সরকার পতন আন্দোলন কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগর বিএনপি কাঙ্ক্ষিত সক্ষমতা দেখাতে না পারলে দুই শাখার শীর্ষ নেতৃত্বের কপালে দুঃখ আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হক বলেন, এ ধরনের কোনো কমিটি গঠনের কথা আমি জানি না। তাই বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালামও বিষয়টি জানেন না বলে দাবি করেছেন।
সন্দেহভাজন নেতাদের নজরদারির জন্য দলের পক্ষ থেকে গঠিত কমিটির প্রধান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি ‘পরে’ কল করতে বলে এড়িয়ে যান। এরপর তিনদিন ধরে কল করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে সদ্য সাবেক বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা উকিল আব্দুস সাত্তার দলীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজের ছেড়ে দেওয়া আসনে উপ-নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হওয়ায় ভবিষ্যতেও এমন দৃষ্টান্ত তৈরি হতে পারে আশঙ্কা বিএনপির।
বিষয়টি নিয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল জাগো নিউজকে বলেন, আমরা কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন এবং সতর্ক। যদিও এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার কৌশলও দলের আছে ।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি থেকে আগেও অনেক বড় তারকা গেছেন কিন্তু বিএনপির তাতে কিছু যায়-আসেনি। সামনেও এমন হলে শূন্যস্থান পূরণের কৌশল এখন আমাদের জানা আছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন খান মোহন বলেন, ‘৩০ ফুট তৈলাক্ত বাঁশে একটা বানর প্রতি মিনিটে তিন ফুট ওঠে আর দুই ফুট নামে। বাঁশের মাথায় উঠতে বানরের কতক্ষণ লাগবে?’ বিএনপির অবস্থা এই গল্পের মতো। অগোছালো সাংগঠনিক প্রক্রিয়া, সামঞ্জস্যহীন কর্মসূচি! সব মিলিয়ে বিএনপির অভাবের সংসারে সন্দেহ অবিশ্বাস থাকাটা স্বাভাবিক। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপি’র যদি সমঝোতা না হয় সেক্ষেত্রে উকিল আব্দুস সাত্তারের মতো শতাধিক উদাহরণ তৈরি হতে পারে। যদি সন্দেহভাজন নেতাদের তালিকা করে ব্যবস্থা নেয় সেক্ষেত্রে বিএনপি খুব বেশি লাভবান হবে বলে মনে করি না। কারও বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হলে তার জন্য অবশ্যই শক্তিশালী প্রমাণ থাকা দরকার।