দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আয়ত্তে আনা যাচ্ছে না কিছুতেই। এক মাসের রেকর্ড ভাঙছে আরেক মাস। এ বছর জুলাইয়ের পর বেশি রোগী বাড়ে আগস্টে। ওই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৭১ হাজার ৯৭৬ জন। তার চেয়েও বেশি রোগী হওয়ার পথে চলতি সেপ্টেম্বর মাস। এখন প্রতি দিন গড়ে ৩ হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। সেই হিসাবে আগামী কয়েকদিনেই আগস্টের পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে নতুন রেকর্ড গড়বে সেপ্টেম্বর। চলতি মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৬৬ হাজার ৯৫০ জন।
২০১৯ সালের পর এবারই (চলতি বছরে) প্রথম ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ লাখ, যা ওই বছরের দ্বিগুণ। ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। আর চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২০১৯ সালের প্রায় পাঁচ গুণ। সে বছর মারা গেছেন ১৭৯ জন, আর এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের ২৫ তারিখ পর্যন্ত মারা গেছেন ৯২৮। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন নিয়তির ওপর নির্ভর করছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত ১ জানুয়ারি থেকে এখনও (২৫ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক লাখ ৯০ হাজার ৭৫৮ জন এবং মারা গেছেন ৯২৮ জন। এর আগে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়— এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। সেই রেকর্ড ভেঙে গেছে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে— ৭১ হাজার ৯৭৬ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০০০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০০১ সালে ৪৪ জন, ২০০২ সালে ৫৮ জন, ২০০৩ সালে ১০ জন, ২০০৪ সালে ১৩ জন, ২০০৫ সালে চার জন এবং ২০০৬ সালে ১১ জন মারা যায়। ২০০৭ সালে থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রন্ত হয়ে কেউ মারা যাননি। ২০১১ সালে মারা যান ৬ জন, ২০১২ সালে একজন, ২০১৩ সালে দুই জনের মৃত্যু হয়। ২০১৪ সালে কেউ মারা যাননি। ২০১৫ সালে মারা যান ৬ জন, ২০১৬ সালে ১৪ জন, ২০১৭ সালে ৮ জন, ২০১৮ সালে ২৬ জন, ২০১৯ সালে ১৭৯ জন, ২০২০ সালে ৪ জন, ২০২১ সালে মারা যান ১০৫ জন।
২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ২৮১ জনের মৃত্যু হয়, যা ছিল দেশে এক বছরে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। সেটিকে ছাড়িয়ে গেছে এ বছর।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের ৬১ শতাংশই পুরুষ এবং বাকি সব নারী। চলতি বছর জানুয়ারি মাসে আক্রান্ত হন ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন, মে’তে ১ হাজার ৩৬ জন, জুনে ৫ হাজার ৯৫৬ জন, জুলাইয়ে ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন, আগস্টে ৭১ হাজার ৯৭৬ জন এবং সেপ্টেম্বরে এখনও পর্যন্ত ৬৬ হাজার ৯৫০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
মৃত্যুর তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, এপ্রিলে ২ জন, মে’তে ২ জন, জুনে ৩৪ জন, জুলাইয়ে ২০৪ জন, আগস্টে ৩৪২ এবং সেপ্টেম্বর মাসে ২৫ তারিখ পর্যন্ত ৩৩৫ জন মারা গেছেন।
ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ৬৩ শতাংশ মারা যাচ্ছেন হাসপাতালে ভর্তির এক দিনের মধ্যে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মারা যাওয়া ৮৯ জনের তথ্য বিশ্লেষণ করে একথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অধিদফতরের মতে, সব মিলিয়ে ৮৭ শতাংশ রোগী মারা যাচ্ছেন হাসপাতালে ভর্তির ৩ দিনের মধ্যে। আর বেশিরভাগ রোগী মৃত্যুর কারণ হচ্ছে ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মুশতাক আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ এখন পুরোপুরি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। কীটতত্ত্ববিদ এবং স্বাস্থ্যবিদদের পাশাপাশি এখন আবহাওয়াবিদকে যুক্ত করতে হবে। কারণ, বৃষ্টি কবে থামবে সেটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। এখন আর আশা করার কিছু নেই যে, এডিস মশা কমে যাবে। এখন আমাদের ভাবতে হবে, কীভাবে মৃত্যু কমানো যায়।’
তিনি বলেন, ‘মৃত্যু কমাতে হলে আমাদের প্রাথমিক পর্যায়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এখনও অনেক জায়গায় সেটি সহজলভ্য নয়। জ্বর আসার পর ডেঙ্গু শনাক্ত করতে পারলে চিকিৎসার মাধ্যমে মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব। কারণ, বেশিরভাগ মৃত্যু হচ্ছে দেরিতে চিকিৎসা নেওয়ার কারণে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন নিয়তির ওপর নির্ভরশীল। কারণ, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেসব কাজে আসছে না। সুতরাং, ব্যবস্থাগুলো কার্যকর নয়। তাহলে এখন নিয়তির ওপর নির্ভর করতে হবে!’
তিনি বলেন, ‘নিয়তি বলতে বুঝাচ্ছি যে, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, পানি জমে থাকা এবং মশার প্রজনন। প্রজনন যত বেশি হবে, যত দীর্ঘায়িত হবে, ততদিন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাবে। যেহেতু কোনও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কাজে আসছে না, সুতরাং বলা যাচ্ছে না কতদিনে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।’