মব জাস্টিসের ইতিহাস

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৬ মার্চ ২০২৫, ১১:৩৭
গুঁড়িয়ে দেওয়া ঢাকার ধামরাইয়ে বুচাই পাগলার মাজার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৪ মার্চ ছিনতাইকারী তকমা দিয়ে ইরানের দুই নাগরিককে মারধর করে উচ্ছৃঙ্খল জনতা। এতে ওই দুজন আহত হন। তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ। পুলিশের ভাষ্য, ইরানের এই দুই নাগরিক ছিনতাইকারী ছিলেন না। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। একপর্যায়ে ছিনতাইকারী তকমা দিয়ে তাঁদের মারধর করা হয়।
এটি শুধু একটিমাত্র ঘটনা। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা বেড়েছে। এসব ঘটনা ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ পত্রপত্রিকায় ‘মব’ ও ‘মব জাস্টিস’ শব্দ দুটি আলোচনায় রয়েছে।
ইংরেজি শব্দ ‘মব’-এর অর্থ ‘বিশৃঙ্খল জনতা’। আর সরল ভাষায় এই বিশৃঙ্খল জনতা নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে সহিংসতা করলে তাকে ‘মব জাস্টিস’ বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বলে।
বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত, পাকিস্তান ও আফ্রিকার দেশগুলোতে মব জাস্টিসের প্রবণতা বেশি। আফ্রিকার দেশ উগান্ডার বিচারব্যবস্থার উদ্যোগে পরিচালিত সরকারি প্রকল্প জাস্টিস সেন্টার্স উগান্ডার ওয়েবসাইটে ‘মব জাস্টিসের’ বিস্তারিত সংজ্ঞা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মব জাস্টিস হলো অপরাধে জড়িত থাকার সন্দেহে কোনো ব্যক্তিকে অবমাননা, মারধর, হত্যা বা সম্পদ ধ্বংসের মাধ্যমে সাজা দেওয়া বা প্রতিশোধ নেওয়া। এ প্রক্রিয়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ পান না। উচ্ছৃঙ্খল জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। মব জাস্টিসের মাধ্যমে কোনো ন্যায়বিচার হয় না। কারণ, এখানে সাক্ষী, বিচারক ও শাস্তিদাতা—সবকিছুর ভূমিকায় থাকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা।
জাতিসংঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত বৈশ্বিক ঘোষণা অনুযায়ী, মব জাস্টিসের কারণে মানবাধিকারের বড় লঙ্ঘন হয়। একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালের অধীনে সবার সমতার ভিত্তিতে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার, তাঁকে যেন নিরপরাধ বলে বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে বিচারের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকতে হবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত বৈশ্বিক ঘোষণা অনুযায়ী, মব জাস্টিসের কারণে মানবাধিকারের বড় লঙ্ঘন হয়। ঘোষণার ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালের অধীনে সবার সমতার ভিত্তিতে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আর ঘোষণার ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার—তাঁকে যেন নিরপরাধ বলে বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে বিচারের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) হিসাবে, গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সাত মাসে গণপিটুনিতে অন্তত ১১৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৭৪ জন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মোট ৭৯২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালে। গত বছর এ ধরনের ঘটনায় ১৭৯ জন নিহত হয়েছেন।
ইতিহাসে ‘মব জাস্টিস’
মব জাস্টিসের ইতিহাস খুঁজতে আমাদের সুদূর অতীতে যেতে হবে। সামাজিক ব্যবস্থায় মানুষের বসবাসের শুরু থেকেই মব জাস্টিস ছিল। তখনকার সমাজে লিখিত কোনো আইন ছিল না। বিচারকাজ চলত সম্প্রদায়কেন্দ্রিক রীতিনীতির ভিত্তিতে। অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তিকে কী সাজা দেওয়া হবে, সে সিদ্ধান্ত নিতেন সম্প্রদায়ের সদস্যরা মিলে। এই সাজাগুলো ছিল নৃশংস। সাজা দেওয়া হতো জনসম্মুখে। উদ্দেশ্য, অপরাধগুলো যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে।
বিগত শতকগুলোর দিকে তাকালেও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এর মধ্যে বহুল আলোচিত ১৬৯২ ও ১৬৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনা। হিস্ট্রি চ্যানেলের তথ্য অনুযায়ী, কালোজাদু চর্চার অভিযোগ তুলে তাঁদের ‘ডাইনি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পেছনে কাজ করেছিল কুসংস্কার, জনরোষের ভয় ও ধর্মীয় উগ্রবাদ।
এই যুক্তরাষ্ট্রেই ১৮৮২ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত আবার বড় পরিসরে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে। বর্ণবিদ্বেষের কারণে সে সময় দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে হাজারো কৃষ্ণাঙ্গ হামলার শিকার হয়েছিলেন। বিনা বিচারের আফ্রিকা বংশোদ্ভূত বহু আমেরিকানকে হত্যা করা হয়েছিল।
ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের সময় ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, তার একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল মব জাস্টিস। সে সময় প্যারিসের বাস্তিল দুর্গে হামলা চালিয়েছিল উচ্ছৃঙ্খল জনতা। শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়েছিল বহু মানুষকে।
গত শতকের প্রথমার্ধে নাৎসি জার্মানিতে রাষ্ট্রীয় সমর্থনে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে। ইহুদি, রাজনৈতিক বিরোধী ও প্রান্তিক বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খল জনতাকে লেলিয়ে দিয়েছিল জার্মান সরকার।
বিশ্বের ইতিহাসে দগদগে ক্ষত হয়ে আছে মব জাস্টিসের আরেক উদাহরণ—রুয়ান্ডা গণহত্যা। ১৯৯৪ সালে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানার মৃত্যুর পর রুয়ান্ডজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র ১০০ দিনে প্রায় আট লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। নিহত বেশির ভাগ মানুষই ছিলেন দেশটির তুতসি সম্প্রদায়ের। গণহত্যা চালিয়েছিল মূলত হুতু সম্প্রদায়। এই গণহত্যার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল মব জাস্টিস।
দেশ ও পরিস্থিতিভেদে মব জাস্টিসের কারণ ভিন্ন হতে পারে। তবে এর পেছনে মূল একটি কারণ হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা কমে আসা।
একবিংশ শতকে দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকায় আশঙ্কাজনক হারে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। দক্ষিণ এশিয়ার কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে ভারতের কথা। বিশেষ করে দেশটির মুসলিম ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর বিশৃঙ্খল জনতার হামলার খবর প্রায়ই সামনে আসে। সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৪ জুন দেশটিতে জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর এ ধরনের হামলা বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। ওই মাসের ৭, ১৮, ২২, ২৪ ও ৩০ তারিখে বিভিন্ন রাজ্যে মব জাস্টিসের খবর সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়।


এর মধ্যে ৭ জুন ছত্তিশগড় রাজ্যের রাইপুরে গরু চোরাচালানের অভিযোগে মুসলিম দুই ব্যক্তিকে মারধর করে হিন্দুত্ববাদী উচ্ছৃঙ্খল জনতা। ওই ঘটনায় আহত একজন কিছুদিন পরে মারা যান। ১৮ ও ২২ জুন উত্তর প্রদেশ ও গুজরাটে পৃথক ঘটনায় দুজন মুসলিম ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২৪ জুন ছত্তিশগড়ের দান্তেওয়াদা জেলায় এক নারীকে হত্যা করে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা। এর কিছুদিন আগে ওই নারী ও তাঁর পরিবারের কয়েকজন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
মব জাস্টিসের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে দেওয়া বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য। গত ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়া হেট ল্যাবের প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগের বছরের তুলনায় ২০২৪ সালে ভারতে সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য ৭৪ শতাংশ বেড়েছে। গত বছর ভারতে ১ হাজার ১৬৫টি বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ ঘটনায় মুসলিমদের নিয়ে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। বক্তব্যদাতাদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও।
পাকিস্তানেরও উচ্ছৃঙ্খল জনতার আইন হাতে তুলে নেওয়া খবর প্রায়ই সামনে আসে। বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে মব জাস্টিসের বেশির ভাগ ঘটনা ঘটে ধর্ম অবমাননার অভিযোগকে কেন্দ্র করে। এর মধ্যে ২০২৩ সালের ১৬ আগস্ট পাঞ্জাব প্রদেশের ফয়সালাবাদ জেলায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি ও গির্জায় প্রায় ১০ ঘণ্টা ধরে হামলা চালানো হয়। ওই ঘটনার পর ১৩০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ছাড়া গত বছরের জুনে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের সোয়াত জেলায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে থানা থেকে একজন খ্রিষ্টান পর্যটককে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনা সে সময় ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল।
আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, উগান্ডা, ঘানা ও কেনিয়ায় মব জাস্টিসের প্রবণতা বেশি বলে সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন ঘানার কয়ামে এনক্রুমাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির আইনের অধ্যাপক মামে এফুজা আদ্দাদজি-কুম। তিনি বলেন, এই দেশগুলোতে অপরাধের মামলাগুলো পর্যালোচনা করলে মব জাস্টিস, চুরি ও ডাকাতির ঘটনা সবচেয়ে বেশি দেখা যাবে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে, গত এক দশকে নাইজেরিয়ায় অন্তত ৫৫৫ জন মব জাস্টিসের শিকার হয়েছেন। ২০২৪ সালের মার্চে প্রকাশিত ‘হোয়াই উই কিল’ বইয়ের লেখক কার্ল কেম্পের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ২৭ হাজার মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। এর মধ্যে ১ হাজার ৮৯৪ জন অর্থাৎ প্রায় ৭ শতাংশ মানুষ মব জাস্টিসে প্রাণ হারিয়েছিলেন। এই সংখ্যাটা ছিল আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের অতিথিকক্ষে তোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়ছবি: সংগৃহীত
গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পরপর আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। তখন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থকদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটে। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত দেশের ৪৯ জেলায় হামলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তত ১ হাজার ৬৮টি ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গত জানুয়ারির মাঝামাঝি পুলিশের অনুসন্ধানের বরাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, ৪ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের ১ হাজার ৪১৫টি অভিযোগের মধ্যে ৯৮ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। আর ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ ঘটনা ঘটেছে সাম্প্রদায়িক কারণে।
সরকার পতনের পরের মাসগুলোতে মাজার ও ওরসে বিশৃঙ্খল জনতার হামলার ঘটনাও ঘটেছে। সবশেষ গত ৩ মার্চ রাতে নেত্রকোনায় কেন্দুয়ায় মাসকা বাজারসংলগ্ন হজরত শাহ নেওয়াজ ফকিরের মাজারে ওরস আয়োজনকে কেন্দ্র করে তোরণ, প্যান্ডেল ও আলোকসজ্জায় ‘তৌহিদি জনতা’র ব্যানারে ভাঙচুর করা হয়। এর আগে ১ মার্চ দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে ‘রহিম শাহ বাবা ভান্ডারি মাজারে’ হামলা-অগ্নিসংযোগের পর ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
উচ্ছৃঙ্খল জনতার হামলার কারণে গত ২৯ জানুয়ারি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নারীদের প্রীতি ফুটবল ম্যাচ বাতিল করা হয়। আগের দিন একদল মানুষ মিছিল নিয়ে এসে খেলার মাঠের টিনের বেড়া ভাঙচুর করেন। ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার (লাইভ) করা হয়। এর আগে গত নভেম্বরে নারায়ণগঞ্জে আপত্তির মুখে দুই দিনব্যাপী ‘মহতি সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা’ বন্ধ করা হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় ওই মেলা পরিচালনার অনুমতি দেয়নি স্থানীয় প্রশাসন।
গত ১ মার্চ রাজধানীর লালমাটিয়ায় চায়ের দোকানে ধূমপান করাকে কেন্দ্র করে দুই তরুণীকে লাঞ্ছিত করা হয়। এ ঘটনায় সম্প্রতি রিংকু নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ বলছে, এক তরুণীর ধূমপান নিয়ে আপত্তি তুললে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে জড়ো হন। একপর্যায়ে রিংকু নামের ব্যক্তি তরুণীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও শারীরিক লাঞ্ছনার চেষ্টা করেন।


মব জাস্টিসের কারণ ও প্রতিকার
দেশ ও পরিস্থিতিভেদে মব জাস্টিসের কারণ ভিন্ন হতে পারে। তবে এর পেছনে মূল একটি কারণ হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা কমে আসা।
এ বিষয়ে নাইজেরিয়ায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক ইসা স্যানুসি বলেন, উচ্ছৃঙ্খল জনতার সৃষ্টি করা সহিংসতা দমনে এবং জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা মব জাস্টিসের প্রতি মানুষকে আরও আগ্রহী করে তোলে। এই সমস্যাকে আরও জোরদার করে তোলে দুর্বল ও দুর্নীতিপরায়ণ আইনি ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও আইনশৃঙ্খলার অবনতিকে বড় একটি কারণ হিসেবে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধবিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিপূর্ণভাবে সক্রিয় না থাকলে মব জাস্টিস সক্রিয় হয়ে ওঠে। সমাজের বিভিন্ন অংশ তখন নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য একত্রিত হয়ে বিশৃঙ্খলা করে। কোনো একটি দেশে গণ-অভ্যুত্থানের পরে বা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে অনেকে অভ্যুত্থানকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দিতে চান বা অভ্যুত্থান থেকে নিজের স্বার্থ আদায় করতে চান। এই ব্যক্তিদের ইন্ধনে বিভিন্ন গোষ্ঠী প্রভাবিত হয়। বাংলাদেশেও সেটা হচ্ছে।
৫ আগস্টের পর মব জাস্টিসের ঘটনা বৃদ্ধির আরও কয়েকটি প্রেক্ষাপট রয়েছে বলে মনে করেন তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, আরেকটি কারণ হলো রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের অস্তিত্ব রাখা না রাখার প্রশ্নে বা ওই মতাদর্শের অনুসারীদের শিক্ষা দেওয়ার প্রশ্নে, তাঁদের রাজনৈতিক আদর্শকেন্দ্রিক যে স্থাপনাগুলো আছে সেগুলো ভাঙচুর করা হচ্ছে, মব জাস্টিস করা হচ্ছে। পূর্বশত্রুতা বা ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকেও মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটছে। ব্যক্তিগত কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অনেকে অর্থের বিনিময়ে বা অর্থ ছাড়াই লোক জড়ো করছেন। এরপর কাউকে অভিযুক্ত করে আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া হচ্ছে।
এই অপরাধবিশেষজ্ঞ বলেন, মব জাস্টিসের মতো ঘটনা যখন বাড়ছে, তখন রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে কঠোর বার্তা দিতে দেরি হচ্ছে। আর বার্তা যেটুকু দেওয়া হচ্ছে, তাতে কঠোরতা কম। ফলে মব কমছে না। এরই মধ্যে অনেককে আবার মবের মতো ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে বৈধতা দিতে চাচ্ছেন। এটাও একটি শঙ্কার বিষয়।
মব জাস্টিস নিয়ন্ত্রণে করণীয় কী—সে প্রসঙ্গে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তা ইসা স্যানুসি ও অপরাধবিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হকের ভাষ্য অনেকটাই একই। তাঁরা দুজনই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জোরদার করার বিষয়ে মত দিয়েছেন। প্রথম আলোকে তৌহিদুল হক বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি দ্রুত নিজেদের ঘাটতি পূরণ করে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে, নিরপেক্ষ ভূমিকা রেখে আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করতে পারে, তখন মব অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
মব নিয়ন্ত্রণে আচরণগত সংশোধনও একটি উল্লেখযোগ্য উপায়। তবে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি যাত্রা বলে মনে করেন তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, একটি দেশের মানুষকে যতক্ষণ পর্যন্ত নাগরিক যোগ্যতায় পরিপূর্ণ না করা যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের মধ্যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা থাকবে, অন্যের অধিকার সম্মানের প্রতি তারা কোনো ভ্রুক্ষেপ করবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, পাঠ্যপুস্তকে আচরণগত সংশোধনের বিষয়গুলো যুক্ত করার মাধ্যমে মানুষকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায়। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও এ প্রক্রিয়া রয়েছে। তবে এ ধরনের শিক্ষার প্রতিফলন বাস্তবে কম।
সূত্র: প্রথম আলো