জামিনে বেরোনোর আগেই নতুন মামলায় গ্রেপ্তার আতঙ্ক

আইনের অপব্যবহার এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে : জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফারজানা ইয়াসমিন
ডেস্ক রেপোর্ট
  ২১ জুন ২০২৫, ১১:৫৯

জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক পালাবদলের পর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি জোরালোভাবে উচ্চারিত হয়েছে। তবে বাস্তবে বহু ক্ষেত্রে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ও আইনজীবীরা। বিশেষত বিগত সরকারের নেতাকর্মী কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে এজাহারনামীয় বা অজ্ঞাতনামা আসামি করে একের পর এক মামলা দায়ের ও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটছে। জামিন পেয়ে বেরিয়ে আসার আগেই নতুন মামলায় হচ্ছেন গ্রেফতার।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, কারও সঙ্গে মামলার প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও শুধু আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গসংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে অতীতে যুক্ত থাকার কারণে নতুন নতুন মামলায় জড়ানো হচ্ছে। বারবার রিমান্ড ও জামিনের মধ্য দিয়ে চলতে থাকা এই প্রক্রিয়াকে ‘হয়রানি’ হিসেবে দেখছেন অনেক আইনজীবী।
যদিও নিরাপরাধ মানুষ যেন কোনও মামলায় গ্রেফতার না হন, সেই বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল নিজেই একথা জানিয়েছেন। তিনি গত এপ্রিল মাসে ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেউ মামলা করতে চাইলে আমরা বাধা দিতে পারি না। তবে মামলা হলেই গ্রেফতার নয়। নিরীহ মানুষ যেন কোনোভাবে হয়রানির শিকার না হন, সেই ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেখানে বস্তুনিষ্ঠতা নেই, সেখানে যতভাবে আইনগত প্রতিকার দেওয়া সম্ভব, সেগুলো দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
তবে এসব নির্দেশনা অমান্য করেই গ্রেফতার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আইনজীবীদের। তারা বলছেন, তদন্ত কর্মকর্তারা এসব গ্রেফতারে আদালতে যে ‘ফরোয়ার্ডিং’ দাখিল করেন, সেখানে প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দেখা যায়, ‘তদন্তে আসামির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে; মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে গ্রেফতার প্রয়োজন’। একবার গ্রেফতার দেখানো হলে দীর্ঘদিন জামিন না পাওয়ার নজিরও রয়েছে। জামিন পেলেও জেলগেট থেকে বের হওয়ার সময় নতুন মামলায় আবার গ্রেফতার দেখানোর উদাহরণ বাড়ছে।
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ৮৩ বছর বয়সী এই প্রবীণ রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে রয়েছে ১১টি হত্যা মামলা। তিনি ২০১৯ সাল থেকেই রাজনীতি থেকে অবসরে গিয়েছেন, অংশ নেননি সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনেও। তার শরীরে পাঁচটি রিং বসানো, লাঠির সাহায্যে চলাফেরা করা এই মানুষটি সবগুলো মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন পেলেও কারামুক্তির আগমুহূর্তে তাকে আবার একটি নতুন মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়—২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টন থানায় দায়ের হওয়া গণ-অধিকার কর্মী বদরুল ইসলাম সায়মনকে হত্যাচেষ্টার মামলায়।
বাংলাদেশ পিপলস পার্টির (বিপিপি) চেয়ারম্যান এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক বাবুল সরদার চাখারীকেও একই ধরনের প্রক্রিয়ায় হয়রানি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাকে গত বছরের ১৮ নভেম্বর যুবদল নেতা শামীম হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়। সেই মামলায় তিন দিনের রিমান্ডের পর তার বিরুদ্ধে আরও চারটি মামলা দায়ের হয়। সবগুলো মামলায় জামিন পাওয়ার পর ১৬ জুন তার মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও জেলগেট থেকেই নতুন মামলায় (বদরুল ইসলাম সায়মন হত্যাচেষ্টা) তাকে ফের গ্রেফতার দেখানো হয়।
তার স্ত্রী নাজমা আক্তার বলেন, ‘ডিবি অফিস থেকে বলেছিল, চিন্তার কিছু নেই, ওনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তখন থেকেই উনি কারাগারে। আট মাস হয়ে গেলো।
বাবুল সরদার চাখারী নিজে আদালতে বলেন, ‘আমি কখনও আওয়ামী লীগ করিনি। বরং ২০২১ সাল থেকে ২০ দলের সঙ্গে আছি। হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করেছি। তাহলে কীভাবে আমাকে ভাঙচুরে জড়ানো হলো?’
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবু জাফর, যিনি ‘শোভন-রাব্বানী’ কমিটির সহ-সম্পাদক ছিলেন, রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে ব্যবসায় মনোনিবেশ করলেও ৫ আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। হাইকোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার পর তাকে আবার নতুন দুটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
তবে শুধু তিনিই নন—ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি নিশিতা ইকবাল নদী, মাস্টারদা সূর্যসেন হল ছাত্র সংসদের সাবেক নেতা সাগির হোসেন সুমনের বিরুদ্ধেও একই রকম গ্রেফতার-পুনঃগ্রেফতার ও রিমান্ডের ধারা দেখা যাচ্ছে।
ঢাকার একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফারজানা ইয়াসমিন রাখী বলেন, ‘রাজনৈতিক মামলায় আইনের অপব্যবহার এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এতে বাজে প্রিসিডেন্স বা নজির স্থাপন হচ্ছে। এসব অপব্যবহার আইনের প্রয়োগকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং অভিযুক্তরা ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হচ্ছে। একটি মামলাতে আসামির কোনও সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও তদন্তেপ্রাপ্ত বা সন্ধিগ্ধ আসামি হিসেবে গ্রেফতার করায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা কমছে। তেমনি যারা নির্দোষ তারা আইনের অপব্যবহারের শিকার হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি কোনও মামলায় আসামির সংশ্লিষ্টতা থাকে, তখন তাকে গ্রেফতার দেখানো যেতে পারে। কিন্তু যখনই কোনও মামলায় জামিন হয়, জেলগেইট থেকে বের হবে। তখনই আরেকটা মামলায় গ্রেফতার দেখানোর মানেই বোঝা যায়, প্রতিপক্ষকে আটকানোই যেন তাদের উদ্দেশ্য।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন