শেখ কামাল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রথম পুত্রসন্তান। বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হতো ৭৩ বছর (জন্ম ৫ আগস্ট, ১৯৪৯)। ঘাতকরা তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে হত্যা করেছিল। এই লেখাটি যখন লিখছি তখন আমি বাংলাদেশ থেকে হাজার মাইল দূরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কিছু সময় কাটাচ্ছি শেখ কামালের শৈশবের বন্ধু ইফতেখার হোসেন ডালিমের সঙ্গে তার বাড়িতে। ইফতেখার আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। ১৯৭৪ সালের পর ইফতেখারের সঙ্গে দেখা হলো এবার। দীর্ঘদিন সে প্রবাসে। রাতে শেখ কামালের সঙ্গে কাটানো তার সেই শৈশবকালের স্মৃতি হাতড়ে অনেক কথা বললো। যা অনেকটা ব্যক্তিগত। ইফতেখারের বাবা প্রকৌশলী আবদুল লতিফ ছিলেন তৎকালীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন কমিশনার ও প্রধান প্রকৌশলী। যমুনা সেতু নির্মাণের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি। ইফতেখারের কাছে জানতে চাই কেমন মানুষ ছিলেন শেখ কামাল? ইফতেখার এক কথায় বলে, তখনকার আর দশটা তরুণের মতো প্রাণোচ্ছল। বলে, ‘নিয়মিত আমি আমাদের বেইলি রোডের সরকারি বাড়ি থেকে বিকালে সাইকেল নিয়ে কামালের বাড়িতে যেতাম। কামালেরও তখন একটা সাইকেল ছিল। দুজনে বের হতাম ধানমন্ডি এলাকায় ঘুরতে। সাথী হতো আরও কয়েক বন্ধু’। একসময় ইফতেখাররা ধানমন্ডির ৬ নম্বর রোডে নিজেদের বাড়িতে ওঠে। তখন অনেক সময় সে কামালের সঙ্গে সকাল-বিকাল আড্ডা মারতে তাদের বাড়িতে যেতো। কথা বলতে গিয়ে ইফতেখার কিছুটা আবেগ আপ্লুত হয়ে গেলো। তাকে আর প্রশ্ন করি না। ফিরে আসি নিজের স্মৃতিতে।
শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক দুই বছর নিচে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। কলাভবনের একই ভবনে আমাদের বাণিজ্য ও শেখ কামালের বিভাগ। শেখ কামাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পরিচিত হতে শুরু করে প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবের বড় ছেলে হিসেবে। তখন ঊনসত্তরের গণআন্দোলন শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিদিন সভা আর মিছিল। মিছিলে শেখ কামাল প্রায় প্রতিদিন তার বন্ধুদের নিয়ে যোগ দেয়। তবে কোনও বক্তৃতা দিতে কখনও দেখা যায়নি। আর দশ জনের সাথে সভা শেষে আমাদের সাথে মিছিল করেছে। এখনকার দিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা হয়তো শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনের নাম নাও শুনতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের পেছনে একটি ছোট বেড়ার ঘর। ওপরে টিনের ছাউনি। ভেতরে দুটি টুলে ছয় জন বসতে পারে। এক প্লেট তেহারি আট আনা। দুই প্লেটে দুপুরের খাওয়া হয়ে যায়। বিকালে ঘিয়ের সুগন্ধিওয়ালা সিঙাড়া। শরিফ মিয়ার সহকারী রমজান। খাবার পরিবেশন করে আর কাপ-প্লেট ধুয়ে রাখে। আমার সাথে শেখ কামালের প্রথম দেখা ও কথা সেই শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনে। হেঁটে এসে সে দেখে ভেতরে বসার জায়গা নেই। আমি একটু সরে বসে কামালকে পাশে বসতে বলি। জবাবে বলে সে সামনের লাইব্রেরি চত্বরে বসবে। সে তার তেহারি নিতে এসেছে। চলে যাওয়ার পর শরিফ মিয়া একটু উঁচু গলায় বলে ‘দুই টাকা’। কামাল হাত দেখান। এই হলো শেখ কামাল, যাকে আলাদা করে চেনার উপায় নেই। তবে তাকে চেনার একটা উপায় ছিল, তিনি প্রায়শ দেখতাম একটা লাল জিপ চালাতেন। পরে জেনেছি সেটি ছিল তার বন্ধু ইকবাল মাহমুদ টুকুর। পরে টুকু বিএনপিতে যোগ দিয়ে জ্বালানিমন্ত্রী হয়েছিলেন। বিএনপি আমলে সুযোগ পেলেই সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণে শেখ কামালের চরিত্র হনন একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। বড় বড় নেতা টিভিতে এসে বলতো, শেখ কামাল বাংলাদেশ ব্যাংক লুট করতে গিয়েছিলেন। একবার এই টুকু টিভিতে সত্যটি বলেন ‘ওই দিন ওই গাড়িতে (যেটার ওপর পুলিশ গুলি ছুড়েছিল) আমিও ছিলাম। আমরা কোনও ব্যাংক ডাকাতি করতে যাইনি। পুলিশ ভুলবশত আমাদের গাড়িতে গুলি চালালে কামাল আহত হয়েছিল’। কামালকে দেখতাম মাঝে মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে আসতেন। তখন আমার বিকালটা কাটতো খেলার মাঠে। সেখানে অন্য আরও অনেক ছাত্রীর সাথে সুলতানা আসতেন দৌড় প্র্যাকটিস করতে।
সুলতানা ছিলেন বেশ ফুটফুটে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছেন একজন ভালো দৌড়বিদ হিসেবে। তাকে বলা হতো পূর্ব পাকিস্তানের গোল্ডেন গার্ল। কামাল সুলতানার সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে আবার চলে যেতেন। দুজনেই সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। পরে সুলতানার সাথে তার বিয়ে হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই। মেহদির দাগ না শুকাতেই ১৫ আগস্ট সুলতানাকেও হত্যা করেছিল ঘাতকরা।
শেখ কামালকে কেন মানুষ মনে রাখবেন? বঙ্গবন্ধুর সন্তান বলে? সেটা তো তার জন্মগত সূত্রে পাওয়া । তা নিয়ে তার বা তার ভাইবোনদের কারও কোনও পৃথক অহমিকা কখনও ছিল বলে মনে হয় না। আমার ছোট ভাইয়ের সাথে শেখ জামাল রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে পড়তেন। জামাল বেশ দুরন্ত ছিলেন। অনেক দিন পর ছোট ভাই জেনেছে ও শেখ মুজিবের ছেলে। শেখ কামালকে মানুষ অনেক কারণে মনে রাখবেন। শেখ মুজিব বা বঙ্গবন্ধুর সন্তান বলে শেখ কামালের কোনও অহংকার কখনও ছিল, তা তার শত্রুও বলতে পারবে না। তার বন্ধুর সংখ্যা দেখেছি অগুনতি। সবসময় একসাথে ক্যাম্পাসে ঘোরাফিরা করতো। কালো ফ্রেমের মোটা চশমা। বেশ বাহারি গোঁফ। কিছুটা কোঁকড়ানো ঘন কালো চুল। বলেছি আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও কখনও নেতা হতে চায়নি বা কোনও পদপদবি দখল করতেও না। তবে একসময় তাকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হয়েছিল আরও কয়েকজনের সাথে। এমন ছাত্রলীগ কর্মী কি এখন পাওয়া যাবে?
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনেকটা পরিবারের অগোচরেই চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে। বাবা তখন পাকিস্তানের কারাগারে। বঙ্গবন্ধুর সন্তান মুক্তিযুদ্ধে না গিয়ে কি ঘরে বসে থাকতে পারে? একইভাবে একদিন শেখ জামালও যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম সেনা অফিসার রিক্রুট আর ট্রেনিং হবে ভারতের হিমালয়ের পাদদেশে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির মূর্তি ট্রেনিং ক্যাম্পে। ৬১ জনকে বাছাই করা হলো। শেখ কামাল তাদের একজন। বঙ্গবন্ধুর সন্তান বলে সে কোনও বাড়তি সুবিধা কখনও পায়নি। ভারতের সেনা অফিসারদের প্রশিক্ষণের জন্য যেই বাছাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় এই ৬১ জনকেও তা-ই করতে হয়েছিল।
এই ৬১ জন বাঙালি তরুণের জন্য ক্যাম্পে তৈরি হলো বাঁশের ব্যারাক ওপরে টিনের ছাউনি দিয়ে। কোনও বিদ্যুৎ বাতি নেই। মশার উপদ্রব মারাত্মক। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও খুবই সাদামাটা। চারদিকে জোঁকে কিলবিল করছে। সেখানে ভারতীয় সেনা প্রশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে কঠিন প্রশিক্ষণ চলছে। অক্টোবরের ৯ তারিখ বাংলাদেশের প্রথম ৬১ জন সেনা অফিসারের কমিশন হলো। কমিশন প্যারেডে সালাম নিলেন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তারপর সকলে গেলো যুদ্ধের ময়দানে। শেখ কামালকে পদায়ন করা হলো বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর এডিসি হিসেবে।
দেশে ফিরে শেখ কামাল কিছু দিন পর ফিরে গিয়েছিলেন বেসমারিক জীবনে। নতুন দেশে কত কাজ তখন শুরুর বাকি। কামাল বুঝতেন সব কাজ সকলকে দিয়ে হয় না। তার প্রথম অগ্রাধিকার দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে সংগঠিত করা। শেখ কামালের দাদা ও বাবা দুজনই ক্রীড়া অনুরাগী ছিলেন। শেখ কামালের একটু সুবিধা ছিল তার দেহের উচ্চতার কারণে। আমার বন্ধু ইফতেখার জানালো, শাহীন স্কুলে পড়ার সময় ভালো বাস্কেট বল আর ক্রিকেট খেলতেন কামাল। ক্রিকেটের প্রতি তার টানটা সম্ভবত একটু বেশি ছিল। তখনকার দিনের আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে ঢাকা লীগেও খেলেছেন শেখ কামাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তহল প্রতিযোগিতায়ও নিয়মিত অংশ নিয়েছেন। বাবার মতো কামালও বিশ্বাস করতেন সংগঠন ছাড়া কোনও কিছু নিয়ে সামনের দিকে বেশি যাওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধের আগেই, ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকাকালীন ১৯৬৮ সালে ধানমন্ডি ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ কামাল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম ক্রীড়া সংগঠন আবাহনী ক্লাবের গোড়াপত্তন করেন শেখ কামাল, যেটি আজ দেশের একটি সেরা ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান।
সম্ভবত শেখ কামালই এই উপমহাদেশে প্রথম একজন বিদেশি ফুটবল কোচ বিল হার্টকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলেন। এক কথায় বাংলাদেশের ক্রীড়া অঙ্গনের আধুনিকায়নের যাত্রা শুরু হয়েছিল শেখ কামালের হাত ধরেই।
শেখ কামালের বিচরণ শুধু যে ক্রীড়াঙ্গনে সীমাবদ্ধ ছিল তাই নয়, তিনি একজন সংগীতানুরাগীও ছিলেন। বড় বোন শেখ হাসিনার মতো ভর্তি হয়েছিল দেশের ঐতিহ্যবাহী সংগীত বিদ্যালয় ছায়ানটে। তালিম নিয়েছিল সেতার বাদনে। ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে শেখ কামালের ঘরে গেলে দেখা যায় তার বাজানো সেতারগুলো। একজন ব্যক্তির নিজ কক্ষ তার রুচির যে অনেক পরিচয় দেয় তা বুঝা যায় শেখ কামালের নিজ কক্ষ দেখলে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে মঞ্চনাটকের জগতে এক বিপ্লব ঘটে গেলো। আগে হতো অফিসপাড়ার নাটক। সৌখিন নাট্যচর্চা ছিল সীমিত। কামাল আর বন্ধুরা মিলে গড়ে তুলেছিল ‘ঢাকা থিয়েটার’।
এই থিয়েটারের হয়ে নাটকেও অভিনয় করেছিল শেখ কামাল। শেখ কামাল মেয়ে শিল্পীদের কতটুকু সম্মানের চোখে দেখতেন তা একদিন বলেছিলেন ঢাকা থিয়েটারের তখনকার একজন নামকরা কর্মী ডলি জহুর।
ফিরে যাই সেই পুরানো দিনের স্মৃতিতে। কি না হতে পারতেন বা করতে পারতেন শেখ কামাল, জনক যখন জাতির পিতা আর দেশের রাষ্ট্রপতি? শেখ কামালকে অন্যদের সাথে হত্যা করার পর ক্ষমতা দখলকারী জিয়া অনেক চেষ্টা করেছে শেখ কামালের কোনও ব্যাংক ব্যালেন্স, বাড়ি বা বড় ধরনের কোনও ব্যবসাপাতি আছে কিনা খুঁজে বের করতে। পাননি তো কিছুই। শুধু কিছু খেলার সরঞ্জাম আর কয়েকটি সেতার। জিয়ারও একজন সন্তান এখনও জীবিত। শেখ কামালের সাথে তার কি কোনও তুলনা কেউ করতে পারেন? অথবা বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা কি কেউ একজন শেখ কামালের পাশে নিজেদের দাঁড় করিয়ে নিজেদের পরিমাপ করতে পারবে? আমাদের এই বয়সে বলতেই হয়- না, সেই প্রজন্ম আর কোনোদিন ফেরার সম্ভাবনা দেখি না। ব্যতিক্রম ক’জন থাকতে পারেন। এখন তো সুযোগ-সুবিধা অনেক। কিন্তু তারপরও একজন শেখ কামাল খুঁজে পাওয়া কঠিন। কারণ, যুগের সাথে সাথে সবকিছু পাল্টে গেছে। এখন বিত্তবৈভব মানুষকে সমাজে সমাদর করে, চরিত্র না। প্রতিভার কদর তো অনেক দিন আগেই বিদায় নিয়েছে এই ঘুণে ধরা সমাজ হতে।
শেখ কামালের এই জন্মদিনে কোনও কেক কাটা হবে না। শেখ হাসিনা শেখ কামালকে বলবেন না ‘শুভ জন্মদিন কামাল’। মা ফজিলাতুন নেছা ছেলের জন্য ভালোমন্দ কিছু রান্না করবেন না। বাবা বলবেন না ‘জন্মদিনে বাড়িতে থেকো। মুরুব্বিরা দোয়া করতে আসবে না। ছোট বোন রেহানা আবদার করবেন না ‘ভাইয়া আমাদের খাওয়াতে হবে কিন্তু’। আর ছোট রাসেল সকলের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করবে না বাড়িতে আজ কী হচ্ছে!
এই দিনে শেখ কামালের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। প্রত্যাশা করি, এই প্রজন্ম শেখ কামালের প্রজন্মের কাছ হতে কিছুটা হলেও শিখবে।
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক