প্রতিবেদন

এক দশকের মধ্যে চলতি বছরে দৈনিক হত্যাকাণ্ড সবচেয়ে বেশি 

ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:০২

২০১৬ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী পাঁচ বছর দেশে প্রতিদিন গড়ে ১০টি করে হত্যা মামলা নথিভুক্ত হতো। ২০২১ সালে এ সংখ্যা নেমে আসে নয়টিতে। এমনকি অভ্যুত্থানের বছর ২০২৪ সালেও গড়ে সারা দেশে প্রতিদিন নয়টি করে হত্যা মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। তবে চলতি বছর এ সংখ্যার ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
এ বছরের প্রথম নয় মাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১টি করে হত্যা মামলা হয়েছে। পুলিশের হিসাবে এক দশকের মধ্যে দৈনিক সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডে মামলা দায়ের হয়েছে চলতি বছর। তবে পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, বিগত সময়ে কিছু হত্যা মামলা এ বছর নথিভুক্ত হয়েছে। এটি মামলার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বড় একটি কারণ।
দেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি চলছে। পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দাপ্তরিক কাজে ফিরলেও অপরাধ দমন কার্যক্রমে ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে না পারলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন প্রক্রিয়ায়ও এর প্রভাব পড়তে পারে।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে সারা দেশে ২ হাজার ৯১১টি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে।
এর মধ্যে গত ৩১ মের পূর্ববর্তী সময়ের ৯৫টি মামলা রয়েছে। দৈনিক গড় হিসাব করলে দাঁড়ায় প্রায় ১১টি খুন। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে ৬৮৫টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এরপর ঢাকা মহানগর (ডিএমপির আওতাভুক্ত) এলাকায় ৩৫২টি। এসব হত্যাকাণ্ডের অধিকাংশই সংঘটিত হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে।
আগের বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে সারা দেশে ৩ হাজার ৪৩২টি খুনের মামলা নথিভুক্ত হয়। এর মধ্যে ১৫৮টি মামলা পূর্ববর্তী সময়ের। গণ-অভ্যুত্থানের ওই বছর গড়ে প্রতিদিন প্রায় নয়টি করে খুনের মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে ৮০৩টি। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ডিএমপি এলাকা। রাজধানীতে সে বছর ৩৩৯টি খুনের ঘটনা ঘটে। এরই মধ্যে চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে রাজধানীতে ৩৫২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। শুধু রাজধানীতেই নয়, ঢাকা বিভাগেও গড় হিসাব করলে গত বছরের তুলনায় এ বছর বেশি খুন হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মেগাসিটি ঢাকায় দেশের অন্য সব শহরের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি মানুষের বসবাস।
এর মধ্যে বড় একটি অংশই ভাসমান। তাছাড়া রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনের প্রবণতাও রাজধানীতে বেশি। এজন্যও অনেক বেশি হত্যাকাণ্ড ঢাকায় হয়ে থাকে। ঢাকায় খুনের মতো অপরাধ বেড়ে চলার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত বিবাদ, পারিবারিক কলহ, রাজনৈতিক কারণ, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো অপরাধমূলক ঘটনা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এলাকাভিত্তিক অপরাধের এ ভিন্নতা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হয়। এর ভিত্তিতেই তারা অপরাধ কমিয়ে আনার নানা উদ্যোগ নেয়। কিন্তু অপরাধের কারণ অনুসন্ধান ও মাত্রা কমিয়ে আনতে বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো কাজ হয়নি।

‘গণ-অভ্যুত্থানের পর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং চলমান আইনি কাঠামো যথাযথভাবে বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে। ফলে অপরাধ বেড়েই চলছে। বিচার নিশ্চিত না করা গেলে এ রকম হবে। এর সঙ্গে আছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাস্তব প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ভূমিকা পালনের ঘাটতি ও অপরাধীর রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ও।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং চলমান আইনি কাঠামো যথাযথভাবে বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে। ফলে অপরাধ বেড়েই চলছে। বিচার নিশ্চিত না করা গেলে এ রকম হবে। এর সঙ্গে আছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাস্তব প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ভূমিকা পালনের ঘাটতি ও অপরাধীর রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ও।’
তিনি আরো বলেন, ‘সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন হচ্ছে এখন প্রতিবাদ করলে মানুষ নিগ্রহের শিকার হয়। তার নিরাপত্তা নেই। এ কারণে কোনো মানুষ স্বেচ্ছায় মামলার সাক্ষীও হতে চায় না। একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা অপরাধীদের উৎসাহিত করছে। তারা আরো নৃশংস হচ্ছে।৷ফলে সমাজে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে। মানুষ মনে করছে নিজেকে গুটিয়ে রাখলে, প্রতিবাদ না করলে, অন্যের বিপদ দেখলে নিজে ঘরে ঢুকে গেলে সে নিরাপদ থাকবে। কিন্তু বাস্তবে সে এতে আরো অনিরাপদ হয়ে পড়বে। একটি রাষ্ট্রে যতক্ষণ পর্যন্ত সবাই সবার কাছে নিরাপদ না, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউই নিরাপদ না।’
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদের (২০১৯-২০২৩) সময় গড়ে প্রতিদিন প্রায় নয়টি করে খুনের ঘটনা ঘটেছে। আধিপত্য বিস্তার ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য সে বছর এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। পুলিশের হিসাবে ২০২৩ সালে সারা দেশে ৩ হাজার ২৩টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। গড় হিসাব করলে প্রতিদিন আটটি করে খুনের ঘটনা ঘটেছে সে বছর। এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অধিকাংশই রাজনৈতিক বিরোধী মতকে দমনের জন্য সংঘটিত হয়েছে। এর আগের বছরে ২০২২ সালে সারা দেশে ৩ হাজার ১২৬টি খুনের ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালে সারা দেশে ৩ হাজার ২১৪টি খুনের ঘটনা ঘটে। গড় হিসাব করলে সে বছর প্রতিদিন প্রায় নয় জন করে খুন হয়েছেন। এর আগে ২০২০ সালে ৩ হাজার ৫৩৯টি এবং ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৬৫৩টি খুনের ঘটনা ঘটে। গড় হিসাব করলে এই দুই বছর যথাক্রমে প্রতিদিন ১০ জন করে খুন হয়েছেন।
মূলত ২০১৬ সাল থেকেই দেশে প্রতিদিন গড়ে ১০ জন কর খুন হন। সে বছর সারা দেশে ৩ হাজার ৫৯১ জন, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৫৪৯ এবং ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৮৩০ জন খুন হন। এই তিন বছরেই গড়ে প্রতিদিন ১০ জন করে খুন হয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে (২০১৪-২০১৮) দেশের খুনের ঘটনা ছিল অনেক বেশি। তৃতীয় মেয়াদে এই সংখ্যা কিছুটা কমে আসে। তবে এসব বছরকে ছাড়িয়ে গেছে চলতি বছরের খুনের চিত্র।
মামলা বেড়ে যাওয়া মানে খুন বেড়ে যাওয়া নয় বলে মনে করেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এইচএম শাহাদাত হোসাইন। তিনি বলেন, ‘চলতি বছরে খুনের মামলা কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও এর মানে এই নয় যে খুনের ঘটনাও বেড়েছে। অনেকেই পুরনো বা পূর্ববর্তী বছরে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে মামলা করতে পারেননি। এখন অভিযোগ পাওয়ার ভিত্তিতে মামলা হয়েছে। এ রকম মামলা রয়েছে শতাধিক। আদতে এটি মূলত আইনি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নথিভুক্তকরণের উন্নতির ফল। প্রকৃত হত্যাকাণ্ড বৃদ্ধি নয়। আর আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ পূর্ণ প্রস্তুত ও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।’
সাবেক কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় ও ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর জনরোষের শিকার হয় বাংলাদেশ পুলিশ ও তাদের বিভিন্ন স্থাপনা। সে সময় মারা যান ৪৪ জন পুলিশ সদস্য। আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় যাত্রাবাড়ী, উত্তরাসহ বেশ কয়েকটি থানায়। এরপর কার্যত বন্ধ হয়ে যায় পুলিশের সেবা কার্যক্রম। তিনদিন পরে ৮ আগস্ট সেনাবাহিনীর সহায়তায় কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেন পুলিশ সদস্যরা। থানাগুলো সেনা প্রহরায় টহল কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে। নিরাপত্তা সংকটের মধ্যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সারা দেশেই খুনের পাশাপাশি চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বেড়ে যায়। এর মধ্যে পুলিশের প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার সীমিত করে নেয়া হয়। বিভিন্ন জায়গায় পরোয়ানাভুক্ত আসামি ধরতে গিয়েও হামলা শিকার হতে দেখা গেছে পুলিশকে। ফলে পুলিশ থানার দাপ্তরিক কাজে ফিরলেও কার্যত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারছে না।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ‘বিগত বছরগুলোয় অনেকেই হত্যার শিকার হলেও তাদের পরিবার মামলা করতে পারেননি। গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে এমন মামলা নথিভুক্ত করা হচ্ছে। ফলে চলতি বছর হত্যা মামলার সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। এছাড়া অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সার্বিকভাবে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো বেশি উন্নতি দৃশ্যমান হবে।’
সূত্র : বণিক বার্তা।