সাংবিধানিক স্বীকৃতি চান আদিবাসীরা

নিজস্ব সংবাদদাতা
  ০৯ আগস্ট ২০২২, ১৪:০২

দেশের সমতল ও পাহাড়ের আদিবাসীরা সাংবিধানিক স্বীকৃতি চান। এ জন্য আদিবাসী হিসেবে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা সোচ্চার। সরকার এই দাবি পূরণ না করে সংবিধানে তাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করেছে। এতে তাঁরা ক্ষুব্ধ।
সম্প্রতি তথ্য মন্ত্রণালয় আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার না করার নির্দেশ দিলে নানা মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ প্রেক্ষাপটে আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালে প্রতিবছর ৯ আগস্টকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। এরপর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ দিবসটি পালন করে আসছে।
দিবসটি সামনে রেখে দেশের ৫৪টি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ তাঁদের পরিচয় ও নিজস্ব সত্তা হিসেবে ফের আদিবাসী স্বীকৃতির দাবি জানাচ্ছেন। এ দাবিতে সমতল ও পাহাড়ের আদিবাসীদের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম আজ সকাল ১০টায় ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এর আগে তাঁরা নানা রঙের ব্যানার, ফেস্টুনসহ রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে র‌্যালি করবে। এবারের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য 'ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা।'
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধনকালে জাতীয় সংসদে এমপিদের অনেকে আদিবাসী শব্দ নিয়ে 'নোট অব ডিসেন্ট' দিয়েছিলেন। পরে স্পিকার আদিবাসী শব্দের পরিবর্তে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শব্দটি যুক্ত করেছিলেন।
জাতিসংঘ বলেছে, পৃথিবীর ৯০টি দেশে ৪৮ কোটি আদিবাসী মানুষ আছে। বাংলাদেশে মোট ৪৩টি ভাষা আছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সমীক্ষায় আদিবাসীদের ৩৯টি ভাষা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৪টি বিপন্ন। ভারতের সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর আদিবাসী নারী ধ্রুপদী মুর্মু দেশটির রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। এটি একটি অনন্য ঘটনা।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক ককাসের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান উপদেষ্টা রাশেদ খান মেনন সমকালকে বলেন, ২০০৮ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও আদিবাসী কথাটি ছিল। ২০১১ সালে হঠাৎ করেই আদিবাসী শব্দটি নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। ওই সময়ের এই বিতর্কের সূত্রপাত হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদিবাসী শব্দটি বাদ দিয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সন্নিবেশ করার পেছনে নির্দিষ্ট চিন্তা-ভাবনা ও লক্ষ্য কাজ করেছে। তিনি বলেন, আদিবাসী-বাঙালি মিলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং সমকালকে বলেন, আশা করি একদিন রাষ্ট্রীয়ভাবে আদিবাসী দিবস পালন করা হবে। অদিবাসীদের সঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। দেশের সাধারণ মানুষ আদিবাসীদের অধিকারের প্রতি অনেক শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাঁদের মধ্যে এই সংবেদনশীলতা অনেক বেশি হওয়া প্রয়োজন। সংবিধানে আদিবাসী শব্দের পরিবর্তে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী যুক্ত করার ক্ষেত্রে ইতিহাসের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে সরকারের কাছে দাবি জানান।
আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সদস্য পীর ফজলুর রহমান সমকালকে বলেন, সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এখানে আদিবাসী শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের আদিবাসী বলা যাবে না, সংবিধানের কোথাও এ কথা বলা নেই।
চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সার্কুলারে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার না করতে যে পরিপত্র জারি করা হয়েছে তা সংবিধান ও আইনসম্মত নয়। দেশের জনগোষ্ঠীর কোনো অংশকে কী নামে অভিহিত করা হবে, এ নিয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে না।
জাতীয় মানবধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান সমকালকে বলেন, 'আমরা আদিবাসী শব্দটা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আদিবাসী শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ অবিলম্বে প্রত্যাহারের করতে হবে।'
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগের সদস্য দীপায়ন খীসা সমকালকে বলেন, 'পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সমতল ও উপকূল অঞ্চলে স্মরণাতীতকাল থেকে চাকমা, মারমা, বম, খুমি, গারো, সাঁওতাল এবং রাখাইনসহ ৫৪টির বেশি ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বসবাস। এসব মানুষের নৃতাত্ত্বিক এবং জাতিগত পরিচয় বাঙালি নয়। তাদের স্বকীয় জাতিগত বৈশিষ্ট্যই বলে দেয় তাঁরা আদিবাসী। আমরা আশা করছি, সরকার অচিরেই তার ভ্রান্ত ধারণা পরিত্যাগ করে আদিবাসী জাতিসমূহের নিজস্ব পরিচিতিকে সংবিধানে সন্নিবেশ করবে।'