পনেরোই আগস্টের কালরাত্রিতে শাহাদতবরণকারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ পরিবারের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। সেদিনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে খুনি-চক্র দেশের অগ্রগতিকে, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সকল অর্জনকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। অবৈধপন্থায় রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে সংবিধানের ওপর কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি বিল’ চাপিয়ে খুনিচক্রের দোসর সামরিক সরকার এই ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের পথ রুদ্ধ করেছিল। ২১ বছর সংগ্রাম শেষে ১৯৯৬-এ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন এবং ‘ইনডেমনিটি বিল’ সংবিধান থেকে অপসারণ করে। প্রচলিত আইনে একজন বিচার প্রার্থী বিধানানুযায়ী যে সুবিধাদি পান, সেভাবেই চলে বিচারিক প্রক্রিয়াটি। দীর্ঘ সওয়াল-জবাব শেষে বিজ্ঞ আদালত খুনিদের ফাঁসির রায় ঘোষণা করে। ২০০১-এ বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় এসে বিচারের রায় অকার্যকর ও খুনিচক্রকে রক্ষা করতে নানাবিধ ষড়যন্ত্র করে। এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ রাজপথে-সংসদে সংগ্রাম করে ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে গণরায়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। ফলে খুনিচক্রের দণ্ডাদেশ কার্যকরের পথ অর্গলমুক্ত ও দীর্ঘ ৩৪ বছর পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করে বাঙালির ইতিহাস কলঙ্কমুক্ত হয়। সমগ্র জাতি সেদিন কী হারিয়েছিল তা সামগ্রিকতায় উপলব্ধির দিগন্ত উন্মুক্ত হয়।
বঙ্গবন্ধু সমগ্র জীবনব্যাপী একটিই সাধনা করেছেন, বাংলা ও বাঙালির মুক্তির জন্য নিজকে উৎসর্গ করা। এই সাধনার শুরু ’৪৭-এ দেশভাগের পরপরই। ’৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ এবং ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ গঠন করেন। সেই থেকে ধাপে ধাপে প্রতিটি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব ’৪৮-এর ১১ মার্চে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির পূর্বে ’৪৮-এর ১১ মার্চ ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হতো। বঙ্গবন্ধুর কাছে থাকার দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী আমি। বঙ্গবন্ধুর কাছেই শুনেছি, তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উপলব্ধি করেছি, এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয় নাই। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে।’ সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে মহান ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে সমগ্র জাতিকে জাতীয় মুক্তির এক মোহনায় দাঁড় করিয়েছেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। কোনোদিন মাথা নত করেননি। আজ তিনি টুঙ্গিপাড়ার কবরে শায়িত। আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না, দরদী কণ্ঠে বাঙালি জাতিকে ডাকবেন না ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে। তাঁর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সোনার বাংলা কায়েম করা। গর্ব করে বলতেন, ‘আমার বাংলাদেশ হবে রূপসী বাংলা, সোনার বাংলা, প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড।’
’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৫৬-এর শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪-এর সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন এবং ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন-প্রতিটি সংগ্রামেই বঙ্গবন্ধুর একচ্ছত্র নেতৃত্ব। বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখি ’৫৭ সনে, ভোলার সরকারি স্কুল মাঠের উপনির্বাচনি জনসভায়। তখন আমি ৮ম শ্রেণির ছাত্র। ভোলায় অনুষ্ঠিত এক জনসভায় সোহরাওয়ার্দী সাহেব ও বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেছিলেন। আমরা স্কুলের ছাত্ররাও এসেছিলাম প্রিয় নেতার বক্তৃতা শোনার জন্য। কৈশোরের সে অনুভূতি ভাষায় ব্যক্ত করার নয়। ’৫০-এর দশক থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সব আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ’৬৬-এর ৭ জুন ৬ দফা আন্দোলন চলাকালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রলীগের সার্বক্ষণিক কর্মী, ইকবাল হল (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি। সেদিনের হরতাল কর্মসূচিতে ধর্মঘটী ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করলে তেজগাঁয় শ্রমিক মনু মিয়া, মুজিবুল্লাহসহ ১১ জন শহীদ হন এবং প্রায় ৮’শ লোককে গ্রেফতার করা হয়। আমাদের স্বাধিকার তথা স্বাধীনতার চেতনার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল এদিনটিতে। ’৬৭-এর ১৭ জানুয়ারি ডাকসু’র ভিপি নির্বাচিত হই। তখন ৬ দফা আন্দোলন চলছে, বঙ্গবন্ধু কারাগারে অন্তরীণ। সেদিন রাতে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে গোপন চিঠি পাই। তিনি লিখেছেন, ‘স্নেহের তোফায়েল, তুই ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়ায় আমি খুশি হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, এই ডাকসু’র নেতৃত্বে বাংলাদেশে একটি আন্দোলন গড়ে উঠবে। -মুজিব ভাই।’
’৬৯-এর ১৭ থেকে ২৪ জানুয়রি, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। ৯ ফেব্রুয়ারি ‘শপথ দিবস’ পালনের পর স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পদত্যাগ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি লাগাতার সংগ্রাম শেষে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম প্রদান করি। অতঃপর ২২ ফেব্রুয়ারি সকল রাজবন্দীর মুক্তির পর বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে মুক্ত মানব শেখ মুজিবকে জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করা হয়।
’৭০-এর নির্বাচনে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা এবং ছাত্র সমাজের ১১ দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আমাকে জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দেন এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হই। ’৭০-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ভোলায় নির্বাচনি জনসভা। এদিন ভোলার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ সমাবেশে বঙ্গবন্ধু আমার গুণবাচক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বক্তৃতা করেন। তিনি নেতা-কর্মীদের এভাবেই সম্বোধন করতেন। যখন যে এলাকায় যেতেন সে এলাকার সংগঠক বা নেতাকর্মীকে মহিমান্বিত করে বক্তব্য রাখতেন। নিজে কর্মী থেকে সংগঠক হয়েছেন, সংগঠক থেকে নেতা হয়েছেন, নেতা থেকে জাতীয় নেতা এবং পরিশেষে জাতীয় নেতা থেকে জাতির জনক হয়েছেন। এটি সম্ভব হয়েছে অসংখ্য কর্মীকে তিনি নেতা বানিয়েছেন, অসংখ্য নেতাকে স্থানীয় পর্যায় থেকে উন্নীত করেছেন জাতীয় নেতায়। ফলত সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করে টিকে আছে।
’৭১-এর ৩ জানুয়ারি, রেসকোর্স ময়দানে নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করাবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘৬ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। ৬ দফা আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাঁকে জ্যান্ত কবর দেবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ জনগণের জন্যই ছিল তাঁর রাজনীতি ও কর্মসূচি। তিনি তাঁর বক্তৃতায় সেদিন আরও বলেছিলেন, ‘আমাকে মোনায়েম খান কাবু করতে পারেনি, এমনকি আইয়ুব খানও পারেনি-কিন্তু আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে আপনাদের এই অকুণ্ঠ ভালোবাসা। আপনারা দোয়া করবেন যেন আপনাদের এই ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারি।’ বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসার মর্যাদা তিনি রক্ত দিয়ে পরিশোধ করে গেছেন। কবিগুরুর ভাষায়, ‘আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন, সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে, মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।’
’৭১-এর রক্তঝরা ১৭ মার্চ, সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন চলছে। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২-তম জন্মদিন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে দুপুরে ধানমণ্ডির বাসভবনে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার ৫২-তম জন্মদিনে আপনার সবচাইতে বড় ও পবিত্র কামনা কী?’ উত্তরে স্বভাবসুলভ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ এরপর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে তিনি ব্যথাভারাতুর কণ্ঠে বেদনার্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না-আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এদেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোনও মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু।’
বঙ্গবন্ধুর কথা এবং বক্তৃতায় উদ্ধৃত হতো রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত-জীবনানন্দের কবিতার চরণ। ’৭১-এর রক্তঝরা মধ্য মার্চ, ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা চলছে, বিদেশি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে নজরুলের কবিতার ইংরেজি তরজমা করে বলেছিলেন, ‘I can smile even in hell!’ কবিগুরুর কবিতা থেকে বলেছিলেন, ‘চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’ সে-সময় রক্তঝরা মার্চে একদিকে চলছে আলোচনার নামে ইয়াহিয়ার প্রহসন, অন্যদিকে যুদ্ধ প্রস্তুতি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা প্রতিদিন ঐক্যবদ্ধ হচ্ছি। সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘সংগ্রাম পরিষদ’ গড়ে তোলার কাজ পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে চলেছে। এই মার্চেই টঙ্গীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে বহু শ্রমিক হতাহত হয়। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের এক বিশাল মিছিল ভয়াল গর্জনে সমবেত হয় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। উত্তেজিত শ্রমিকদের উদ্দেশে বক্তৃতা শেষে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেইদিন হবো শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবে না...।’
আশ্চর্যরকম অবলীলায় পরিস্থিতি-পরিবেশের সঙ্গে সংযুক্ত করে মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়ে তিনি এসব কাব্যাংশ উচ্চারণ করতেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেরাদুনে মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে শপথ গ্রহণকালে আমরা সমস্বরে বলতাম, ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ আমরা জানি না। কিন্তু যতদিন আমরা প্রিয় মাতৃভূমি এবং তোমাকে মুক্ত করতে না পারবো, ততদিন আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী দিনগুলোতে বাঙালির চেতনায় বন্দী মুজিব ছিলেন মুক্ত মুজিবের চেয়ে শক্তিশালী। ষড়যন্ত্রকারীদের প্রধান হোতা খুনি মুশতাক তখনই প্রশ্ন তুলেছিল, ‘জীবিত মুজিবকে চাও, না স্বাধীনতা চাও।’ আমরা বলতাম, ‘আমরা দুটোই চাই। স্বাধীনতাও চাই, বঙ্গবন্ধুকেও চাই।’ ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর ২ লক্ষাধিক মা-বোনের সুমহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করেছিলাম। ’৬৬-এর ৮ মে থেকে ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৩ মাস কারাবন্দী ছিলেন তিনি। তাঁর ১৩ বছরের কারা জীবনে দীর্ঘ কারাবাস। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করতে ৯ ফেব্রুয়ারির শপথ দিবসে স্লোগান তুলেছিলাম, ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করবো, শপথ নিলাম শপথ নিলাম মা-গো তোমায় মুক্ত করবো।’
সেদিন আগরতলা মামলায় কারাবন্দী মুজিব ছিলেন মুক্ত মুজিবের চেয়ে শক্তিশালী। দু’বারই আমরা দুর্বার গণআন্দোলন ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে জাতির জনককে কারামুক্ত ও বাংলা মা-কে মুক্ত করেছি। ’৬৯-এর গণআন্দোলনে রাজপথ প্রকম্পিত করা স্লোগান ছিল, ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।’ কিন্তু দুঃখ আর বিষাদের সঙ্গে বলতে হয়, স্বাধীন বাংলাদেশেই ঘৃণ্য ঘাতকেরা জাতির জনককে এমন নির্মমভাবে হত্যা করলো! কিন্তু হত্যা করতে পারলো না বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে। কারণ চেতনার মৃত্যু নেই!
বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরশ পাথরের মতো। তাঁর চেতনায় গোটা বাঙালি জাতি নিরস্ত্র থেকে সশস্ত্র হয়ে সচেতনতার এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল যে আমরা স্বপ্ন দেখতাম শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার। ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি, পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে রেসকোর্সের গণমহাসমুদ্রে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ অশ্রুসিক্ত বলেছিলেন, ‘কবিগুরু, তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে, তুমি ভুল প্রমাণিত হয়েছো, তোমার কথা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে...।’
মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতেন প্রিয় মাতৃভূমিকে, বাঙালি জাতিকে। হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতেন বাঙালির দুঃখ-কষ্ট। বাঙালির জন্য নিজকে বিলিয়ে দিয়ে তিনি বাংলার মাটিতে মিশে আছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। ’৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে অসাধ্য সাধন করেছেন বঙ্গবন্ধু। হিমালয় সমান উচ্চতার তেজোদ্দীপ্ত আমাদের মহান নেতার জাতিসংঘে প্রদত্ত মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতাদানের দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। জাতিসংঘে যে ৬টি ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল তার মধ্যে বাংলা ছিল না। আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রথম বাংলাভাষী এই নেতার বক্তৃতা শুনে সেদিনের উপস্থিত রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা বিমোহিত হন। বাংলা ভাষা সেদিন থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে থেকে দেখেছি তাঁর কৃতজ্ঞতাবোধ, বিনয়, মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা। জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল ন্যায়সঙ্গত। যা কিছু করতেন বা বলতেন, চিন্তা-ভাবনা করেই বলতেন এবং একবার যা বলতেন, সেখান থেকে একচুলও নড়চড় করতেন না। কেবলমাত্র নেতা হওয়ার বাসনা নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের জন্ম বিকাশ ঘটাননি। অসংখ্য নেতা-কর্মী সৃষ্টি করে দেশকে পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত করেছেন। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দক্ষতা বাড়াতে সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন। কোনোরকম পারিবারিক, আমলাতান্ত্রিক বা গোষ্ঠীগত কায়েমী স্বার্থবাদী ফ্রেমে বন্দী থাকার মানুষ তিনি ছিলেন না; ইতিহাসের ফ্রেমে বরণীয় আর আদৃত ছিলেন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েও সরকারি বাসভবনে থাকতেন না। ৩২ নম্বরের বাড়িটিতেই আমৃত্যু থেকেছেন। অপরের দুঃখ-কষ্টের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁকে সর্বদাই আবেগাপ্লুত করতো। একবার এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ আর কী চাইতে পারে-আমি যখন ভাবি দূরে এক জনশূন্য পথের ধারে আধো আলো-ছায়ায় এক লোক লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে আছে শুধু আমাকে এক নজর দেখবে বলে, তখন মনে হয়, একজন মানুষের পক্ষে আর কী চাওয়া-পাওয়ার থাকতে পারে।’ মেহনতী মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা। তা অভিব্যক্ত হয়েছে তাঁর প্রতিটি কর্মে এবং চিন্তায়। ’৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর, আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত শোষক আর শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে।’
’৭৪-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সম্মেলনে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী তখন কারা কর্মকর্তা ছিলেন জনাব হাবিব আলী। তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেখানে। হাবীব আলী আমাদের বলেছিলেন, “বন্দী থাকা অবস্থায়, বিচারকার্য চলাকালীন তোমাদের নেতার মুখ থেকে আমরা একটি শব্দও বের করতে পারিনি। তোমরা মহা সৌভাগ্যবান এমন একজন নেতা পেয়েছো, যিনি সত্যিই মহান। কারাগারের পাশে তার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল এবং আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আত্মপক্ষ সমর্থন বা অন্তিম কোনো ইচ্ছা তোমার আছে কিনা। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে নিয়ে এই নাটকের যখন যবনিকাপাত ঘটবে, আমার অন্তিম ইচ্ছা, আমার লাশটা যেন আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে পাঠানো হয়।’”
কমনওয়েলথ সম্মেলনে তাঞ্জানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নায়ারের সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল, তিনি আমাদের বলেছিলেন, ‘তোমরা এমন একজন নেতা পেয়েছো যিনি শুধু তোমাদের নেতা নন, সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত-মেহনতী মানুষের নেতা তিনি।’
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে তাঁর একটা তহবিল থাকতো আমার কাছে। এই তহবিল থেকে বিভিন্ন জনকে সাহায্য-সহায়তা করতেন। এর মধ্যে দলীয় নেতা-কর্মী ছাড়াও বিরোধী দলের প্রতিপক্ষীয় লোকজনও ছিল। কিন্তু শর্ত ছিল যাদেরকে অর্থ সাহায্য দেওয়া হচ্ছে তাঁদের নাম-ঠিকানা গোপন রাখতে হবে, প্রকাশ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু কখনোই মানুষের মনে আঘাত দিয়ে কথা বলতেন না। তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল মার্জিত। বঙ্গবন্ধুর সময়ানুবর্তিতা-নিয়মানুবর্তিতা ছিল অসাধারণ। নীতির প্রশ্নে ছিলেন অটল। ’৭৪-এ দলের কাউন্সিলে দলীয় পদ ত্যাগ করে সভাপতির পদটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তদস্থলে আসীন হয়েছিলেন জাতীয় নেতা শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান সাহেব। আর ’৫৭তে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দলীয় পদে বহাল করেছিলেন নিজেকে। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত সেটি যেমন বুঝতেন; তেমনি কে কোথায় যোগ্যতর আসনে অধিষ্ঠিত হবেন তাঁকে সে জায়গাটিতে যথাসময়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করাতে ভুল করতেন না মোটেও। বজ্রকণ্ঠের অধিকারী বঙ্গবন্ধু ছিলেন অতুলনীয় বাগ্মী। বক্তৃতার মাধ্যমে জনসাধারণকে আন্দোলিত করার ঐন্দ্রজালিক ভূমিকার জন্য তাঁকে অভিহিত করা হয়েছিল ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে। এই মহান নেতার সংক্ষিপ্ত অথচ বিপুল কর্মময় জীবনে যে আচরণ কাঠামো প্রতিফলিত হয়, তার মধ্যে ছড়িয়ে আছে হিরন্ময় দ্যুতি ছড়ানো মানবিক কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিমানবিক সব আচরণ বৈশিষ্ট্য। আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল ইতিহাসের এই মহামানবের একান্ত সান্নিধ্যে আসার। আমার জীবন ধন্য। বঙ্গবন্ধুর চেতনা অমর, অবিনাশী-এর মৃত্যু নেই!
লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।