বিএনপিতে গ্রেফতার আতঙ্ক

পাঁচ জেলায় সাড়ে ৭ হাজার নেতাকর্মী আসামি, অজ্ঞাত ২১ হাজার
নিজস্ব প্রতিবেদক
  ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:০৯

সারা দেশে গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। মামলা-হামলা, সংঘাত-সংঘর্ষ অব্যাহতভাবে চলছে। নাটোরের লালাপুরে পুলিশ-বিএনপির সংঘর্ষে গতকালও বিএনপির ছয় নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল নিক্ষেপসহ ফাঁকা গুলি ছুড়েছে পুলিশ। মামলার আসামি গ্রেফতারে নেতাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ হানা দিচ্ছে। ফলে বাড়িঘরে থাকতে পারছেন না তারা। 
এক মামলায় জামিন নিয়ে এলাকায় গেলে গ্রেফতারের পর ফের নতুন মামলায় আটক দেখাচ্ছে পুলিশ। এর ফলে অনেকেই এখন এলাকাছাড়া। এমনকি যাদের নামে কোনো মামলা নেই তারাও এখন লুকিয়ে থাকছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মাধমে এসব তথ্য জানা গেছে।
এসব বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের কর্মসূচি চলতেই থাকবে। এসব মামলা-হামলা করে জনগণের আন্দোলন ঠেকানো যাবে না। বিএনপির নেতা-কর্মীরা এসবে আর ভয় করেন না। আমাদের সঙ্গে সাধারণ জনগণও যোগ দিতে শুরু করেছেন। চলতি মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত সারা দেশে আমাদের কর্মসূচি আছে। এরপর আবারও নতুন কর্মসূচি ঘোষণা হবে। এ আন্দোলন চলবে চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচ জেলায় বিএনপির সাড়ে ৭ হাজার নেতা-কর্মীকে আসামি করে ১৭টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষের ঘটনায় নোয়াখালীর পাঁচ উপজেলায় ১৩টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ ৪ হাজার ৬২০ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। সর্বশেষ মামলাটি করা হয়েছে ফরিদপুরে। এ মামলায় কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল ও কেন্দ্রীয় মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী নায়াব ইউসুফসহ পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে মামলায় বিএনপির ২১ হাজারেরও বেশি নেতা-কর্মীকে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে দেখানো হয়েছে।
জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে জানা গেছে, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনায় কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট জালাল উদ্দিনসহ দেড় হাজার নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষের ঘটনায় বরগুনার পাথরঘাটায় সাবেক এমপি নুরুল ইসলাম মনিসহ ৪০০ জনকে আসামি করে হামলা হয়েছে। এসব মামলার পর বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মী বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
অন্যদিকে পুলিশের ওপর হামলা, সরকারি কাজে বাধা এবং জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির অভিযোগে শুধু নোয়াখালীর পাঁচ জেলাতেই ১৩টি মামলা হয়েছে। সুধারাম থানায় তিনটি, বেগমগঞ্জ থানায় দুটি, সোনাইমুড়ী থানায় চারটি, সেনবাগ থানায় দুটি ও চাটখিল থানায় দুটি মামলা করেছে পুলিশ। এতে কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, জেলা বিএনপির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা গোলাম হায়দার বিএসসি, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাকারিয়াসহ বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ১ হাজার ২২০ জনের নামসহ ৪ হাজার ৬২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এসব মামলা হওয়ার পর হাজার হাজার নেতা-কর্মী ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। মামলার আসামি নন এমন নেতা-কর্মীও এখন গ্রেফতার আতঙ্কে বাড়ি ছেড়ে লুকিয়ে থাকছেন। এরই মধ্যে পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিএনপির ১৩৮ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। নোয়াখালীর অনেক এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদেরও বিএনপি নেতাদের বাড়িতে অভিযান চালানোর অভিযোগ উঠেছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট শিহাব উদ্দিন শাহীন।
বরগুনার পাথরঘাটায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় বরগুনা-২ আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম মনি, তার ভাই সাইফুল ইসলাম জামাল, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক চৌধুরী মোহাম্মদ ফারুক, বিএনপি নেতা সেলিম পহলান, আবুল হোসেনসহ ৪০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিঁড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আলাউদ্দিন পল্টুর করা মামলায় ৯৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। পাথরঘাটার রায়হানপুরে রবিবার বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম মনির গাড়িবহর ও নেতা-কর্মীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করেছে বলে দলটি অভিযোগ করেছে।
লালপুরে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষ, টিয়ার শেল নিক্ষেপ, আহত ৬ : নাটোরের লালপুরের গৌরীপুরে পুলিশ-বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে মিছিল করার সময় পুলিশের বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, লাঠিচার্জসহ ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এতে তাদের ছয়জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন বলে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। তবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দাবি, পুলিশকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করায় আত্মরক্ষার্থে পুলিশ দুই রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেছে।
লাঠিচার্জের কোনো ঘটনা ঘটেনি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, যুবদল নেতা শাওন হত্যার প্রতিবাদে সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রয়াত ফজলুর রহমান পটলের বাড়িতে সমাবেশ করেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা। সমাবেশ শেষে মিছিল বের করার চেষ্টা করেন তারা। একই সময়ে এলাকায় আওয়ামী লীগ কর্মীরা মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সংঘর্ষ এড়াতে পুলিশ বিএনপি নেতা-কর্মীদের মিছিলে বাধা দেয়। এতে উত্তেজিত বিএনপি নেতা-কর্মীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় নেতা-কর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশও লাঠিচার্জ করে নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এর পরও পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে পুলিশ টিয়ার শেল ছোড়ে। এ সময় আবদুল মজিদ ও আমির হোসেনসহ বিএনপির ছয়জন কর্মী আহত হন। গতকাল বিকালে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলার একপর্যায়ে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
জেলা বিএনপির সদস্যসচিব রহিম নেওয়াজ বলেন, ‘বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ বিনা উসকানিতে লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ কর্মীরাও মিছিলে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছেন। এতে আমাদের ছয়জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন।’ বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করে বলা হয়েছে, তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের হামলায় যারা আহত হয়েছেন, তাদেরই আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ।