তারা দিনের আলোতে নয়, জীবনের অন্ধকারে কাজ করেন। তাদের হাতে থাকে না কলম বা মাউস, কাঁধে ঝুলে থাকে না ঝকঝকে ব্যাগ। বরং মাথায় হেলমেট, হাতে কুড়াল, পায়ে গামবুট। এরপর ঢুকে পড়েন পৃথিবীর গভীরতম গহ্বরে, আমাদের আলোর জন্য। আজ ৪ মে, কয়লা খনি শ্রমিক দিবস। এই দিনটি উৎসর্গ করা হয় সেইসব শ্রমিকদের জন্য, যারা কয়লার খনি থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তোলন করেন জ্বালানির মূল উপাদান কয়লা।
এই খাত আমাদের আধুনিক জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক হলেও, কয়লা খনির শ্রমিকদের জীবন যেন বরাবরই থেকেছে অবহেলিত ও অদৃশ্য। তারা কাজ করেন ভয়ানক গ্যাসের ঝুঁকি, ধসের আশঙ্কা ও শ্বাসকষ্টজনিত নানা সমস্যার মধ্যে। অনেকেই দিনশেষে শুধু শরীর নয়, জীবনও হারিয়ে ফেলেন এই পেশায়।
চীনের গুইঝো প্রদেশের ফুংচুন কয়লাখনিতে ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে ঘটে যায় এক ভয়ানক দুর্ঘটনা। খনির গভীরে এক বিস্ফোরণে ১৭১ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। গ্যাস জমে থাকা এবং পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল না থাকাই ছিল এই দুর্ঘটনার মূল কারণ। এই শ্রমিকদের কেউ সেদিন সকালে বিদায় নিয়ে গিয়েছিলেন খনিতে, কেউ হয়তো ছেলেকে বলেছিলেন খেলনা কিনে আনবেন, কেউ স্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন রাতে একসঙ্গে বসে খাবেন। কিন্তু তারা কেউই আর ফিরে আসেননি। ফিরে এসেছিল শুধু কিছু মৃতদেহ। কয়লার ধুলোয় মাখা, চেনা যায় না এমন কিছু মুখ।
এই ঘটনাটি শুধু চীনের নয়, এটি বিশ্বব্যাপী খনি শ্রমিকদের দুর্দশার প্রতিচ্ছবি। উন্নত বা উন্নয়নশীল সব দেশেই খনি শ্রমিকদের ভাগ্য যেন একসূত্রে গাঁথা।
বাংলাদেশেও কয়লা খনি শ্রমিকদের অবস্থান তেমনই অন্ধকারে। দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া খনি হোক বা জামালগঞ্জ, এখানকার শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত অমানবিক পরিবেশে কাজ করেন। স্বাস্থ্যসেবা নেই, নিরাপত্তা নেই, নেই শ্রম অধিকার রক্ষার সুস্পষ্ট কাঠামো। অথচ তাদের পরিশ্রমেই কয়লা উত্তোলন সম্ভব হয়, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয়, যা দিয়ে সচল থাকে শহর, দেশ, আমাদের ঘরের বাতি।
৪ মে এলেই কিছু ফুল, কিছু পোস্টার আর কিছু বক্তব্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না এই দিবসকে। সত্যিকারের শ্রদ্ধা তখনই সম্ভব, যখন আমরা তাদের জীবনের মান উন্নয়নে পদক্ষেপ নিই। শ্রমিকদের জন্য আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যবীমা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পর্যাপ্ত বেতন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
খনি শ্রমিকেরা হয়তো আকাশ দেখতে পারেন না, কিন্তু তাদের কপালের ঘামে আমরা আলো পাই। তারা হয়তো সভায় বক্তৃতা দিতে পারেন না, কিন্তু তাদের নীরব উপস্থিতি জাতীয় অগ্রগতির পেছনে শক্ত ভিত হিসেবে কাজ করে।
এই দিবসে আমাদের মনে রাখা উচিত একটি বাতি জ্বলতে যে কয়লা পোড়ে, তা তুলে আনতে হয় অসংখ্য মানুষের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। তারা যেন আর শুধু ‘শ্রমিক’ না থাকে, তাদেরও পরিচয় হোক মানুষ, যার জীবন আলোর সমান মূল্যবান।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, ডয়চে ভেলে