বাংলাদেশে শুকাচ্ছে নদী, বাড়ছে দূষণ, বিলুপ্তির পথে ডলফিন

ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৪:২০


বাংলাদেশের নদীর ডলফিন বিশেষ করে—গঙ্গা নদীর ডলফিন ও ইরাবতী ডলফিন দ্রুতই তাদের আবাসস্থল হারাচ্ছে। দূষণ, পানির প্রবাহ কমে যাওয়া এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে নদীর ব্যবহার দেশের নদীজ প্রতিবেশব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগের সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদন।
“বাংলাদেশের গঙ্গা ও ইরাবতী ডলফিন অ্যাটলাস” শীর্ষক এই গবেষণাটি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও বন বিভাগের যৌথ উদ্যোগে সম্পন্ন হয়েছে। এতে বাংলাদেশের স্বাদুপানি ও উপকূলীয় ডলফিনের আবাসস্থলের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, হালদা এবং কর্ণফুলীসহ প্রধান নদী ব্যবস্থার অন্তত ১০টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে শীতকালীন আবাসস্থল চিহ্নিত করা হয়েছে।
তবে এতে সতর্ক করে বলা হয়েছে, অনেক উপনদী এখন শুষ্ক মৌসুমে ডলফিনের আবাসস্থল হিসেবে উপযুক্ত নয়।
প্রতিবেদনে এ প্রসঙ্গে বলা হয়, “যদিও প্রধান নদীগুলো এখনও গঙ্গা নদীর ডলফিনের জন্য বাসযোগ্য। তবে ধরলা, তিস্তা, সাঙ্গু এবং কুশিয়ারা নদী শীতকালে উপযুক্ত নয়।”
বিলুপ্তির পথে নদীর ডলফিন
একসময় গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র–মেঘনা নদীতে প্রচুর পরিমাণে দেখা যেত গঙ্গা নদীর ডলফিন, স্থানীয়ভাবে যা ‘শুশুক’ নামে পরিচিত। তবে এটি এখন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচারের (আইইউসিএন) তালিকায় বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে শ্রেণিভুক্ত।
বিশ্বে এদের সংখ্যা ১,২০০টিরও কম বলে ধারণা করা হয়, যার মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অবশিষ্ট রয়েছে।
অন্যদিকে, ইরাবতী ডলফিন কিছুটা লবণাক্ত পানিতে সহনশীল হলেও এর বিস্তৃতি সুন্দরবন ও উপকূলীয় এলাকায় সীমিত হয়ে পড়েছে।
কিন্তু সেখানেও নৌযান চলাচল, লবণাক্ততার বৃদ্ধি এবং দূষণ ইরাবতীর টিকে থাকার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে।
বন বিভাগের স্তন্যপায়ী প্রাণীবিদ সাইদ মাহমুদুর রহমান বলেন, “সুন্দরবনের মোহনাগুলোতে ইরাবতী ডলফিনের পরিসর কমে যাচ্ছে। বড় বাণিজ্যিক জাহাজ থেকে আসা দূষণ ও মাছ ধরার জালে জড়িয়ে পড়ে তারা বিপদে পড়ছে।”
দূষণ ও বাঁধে শ্বাসরুদ্ধ নদীজীবন
অ্যাটলাসে বলা হয়েছে, শিল্পবর্জ্য, কৃষিজ রাসায়নিক এবং উজানের ফারাক্কা ও তিস্তা ব্যারেজের কারণে পানির প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে। সব মিলিয়ে নদীর জীবন ধ্বংস হচ্ছে।
পদ্মা ও যমুনার বিভিন্ন স্থানে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেছে। যার ফলে মাছের বৈচিত্র্য কমছে, একইসঙ্গে কমছে ডলফিনের প্রধান খাদ্য।
এছাড়া স্থানীয় জেলেদের অসচেতনতায় তাদের মাছ ধরার জালে মারা যাচ্ছে ডলফিন ।
গোদাগাড়ী ও বরাল (রাজশাহী) এবং মেঘনার ভৈরব সেতুর কাছে প্রায়ই মৃত ডলফিনের সন্ধান মিলেছে— যা একসময় ডলফিনের আশ্রয়স্থল ছিল।
ডলফিন বিষয়ক জরিপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, “নদী মরছে, আর নদীর সঙ্গে ডলফিনও হারিয়ে যাচ্ছে। ডলফিনের বিলুপ্তি আমাদের নদী ব্যবস্থা ধ্বংসের বার্তা।”
হুমকিতে আবাসস্থল, দুর্বল সুরক্ষা
বাংলাদেশ সরকার ৬টি এলাকাকে ডলফিন অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছিল। এগুলো হলো-সুন্দরবনের চাঁদপাই, ধানমারী ও দুধমুখি; এবং পদ্মা–যমুনা মোহনায় সিলন্দা–নাগদারমা, নাজিরগঞ্জ ও নগরবাড়ী–মোহনগঞ্জ।
তবে ২০২২ সালে সুন্দরবনের আশেপাশে আরও ৩টি অভয়ারণ্য যুক্ত হওয়ায় মোট সংখ্যা এখন ৯টি। তবে এসব এলাকায় তদারকি ও ব্যবস্থপনা একদমই দুর্বল।
গবেষকরা অভয়ারণ্যের মধ্যেও অবৈধভাবে মাছ ধরা ও বালু উত্তোলনের প্রমাণ পেয়েছেন।
সতর্ক করে অ্যাটলাসে বলা হয়েছে, “আবাসস্থল খণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে, জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণহীন, আর মৌসুমি পানির প্রবাহ ব্যবস্থাপনা না থাকায় অভয়ারণ্যগুলো কার্যকর হতে পারছে না।”
জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ
জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, দীর্ঘায়িত শুষ্ক মৌসুম এবং লবণাক্ততার পরিবর্তন নদীজ প্রতিবেশব্যবস্থাকে এমন গতিতে বদলে দিচ্ছে, যা ডলফিনের অভিযোজন ক্ষমতার বাইরে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ ও অ্যাটলাসের প্রধান লেখক ড. আব্দুল আজিজ  বলেন, “ডলফিন হলো নির্দেশক প্রজাতি— এদের বেঁচে থাকা নদীর স্বাস্থ্যের প্রতিচ্ছবি। ডলফিন হারিয়ে গেলে বুঝতে হবে নদী নিজেই মৃত্যুর পথে।”
উপেক্ষিত সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা
২০২৩ সালের অক্টোবরে সরকার ডলফিন রক্ষায় ২০২১–২০৩০ মেয়াদি ১০ বছরের সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করে। লক্ষ্য ছিল ডলফিন হত্যার হার ও আবাসস্থল ধ্বংস রোধ করা এবং নদী-নির্ভর জনগোষ্ঠীর জীবনধারাকে টেকসই পথে আনা।
বন বিভাগ, ইউএনডিপি, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে তৈরি এই পরিকল্পনায় নির্দিষ্ট লক্ষ্য, সময়সূচি ও দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছিল।
মূল লক্ষ্য ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে ডলফিন হত্যা ও আবাসস্থল হ্রাস কমানো।

মূল কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল:
ডলফিনের জনসংখ্যা, বিস্তৃতি ও মৌসুমি আবাসস্থল নির্ধারণে জাতীয় পর্যায়ে জরিপ
খাদ্যাভ্যাস, প্রজনন ও অভিবাসন প্যাটার্ন নিয়ে গবেষণা
আধুনিক ট্র্যাকিং টুলে ডলফিনের চলাচল নিরীক্ষণ
দূষণ, বাঁধ ও নৌপথজনিত ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ
দুর্ঘটনাজনিত ও ইচ্ছাকৃত হত্যা কমানো
আবাসস্থল সম্প্রসারণ ও সুরক্ষা
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ
এই কর্মপরিকল্পনার সম্ভাব্য বাজেট ছিল প্রায় ৩০ কোটি টাকা, যা ২০২১–২০৩০ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের কথা ছিল।
তবে বন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি হয়নি।

দীর্ঘদিন ডলফিন নিয়ে কাজ করা বিশিষ্ট প্রাণিবিদ ড. আজিজ বলেন, “অ্যাটলাস আর কর্মপরিকল্পনা প্রকাশের পর ‘সুফল’সহ কিছু প্রকল্পের নাম শোনা গেছে, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে কোনও সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এখনই দেশব্যাপী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করলে, আমাদের জীবদ্দশায়ই ডলফিন হারিয়ে যেতে পারে।”
বন বিভাগ যা বলছে
বন বিভাগের প্রধান সংরক্ষক মো. আমির হোসাইন চৌধুরী বলেন, “কর্মপরিকল্পনার পর আমরা একটি জাতীয় জরিপ করেছি, যেখানে দেশের গঙ্গা নদীর ডলফিনের সংখ্যা প্রায় ১,৩৫২টি হিসেবে পাওয়া গেছে, যা ২০২৪ সালের ২৪ অক্টোবর প্রকাশ করা হয়।”
তিনি আরও বলেন, “এখনও কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বড় কোনও উদ্যোগ নেওয়া যায়নি। আমরা উপকূলীয় এলাকায় সচেতনতা কর্মসূচি চালাচ্ছি, কারণ মাছ ধরার জালই ডলফিন মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর একটি।”
তিনি জানান, আন্তর্জাতিক স্বাদুপানি ডলফিন দিবস প্রতিবছর ২৪ অক্টোবর পালিত হয়। তবে এ বছর ২৪ অক্টোবর শুক্রবার হওয়ায় বাংলাদেশে দিবসটি রবিবার (২৬ অক্টোবর) পালন করা হচ্ছে।