দেশে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হৃদ্রোগ। প্রতিদিন ৫৬২ জন মানুষ মারা যান হৃদ্রোগে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হৃদ্রোগের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে।
দেশে প্রতিবছর কত মানুষ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন, হৃদ্রোগে ভোগা মানুষের সংখ্যা কত, কত শিশু হৃৎপিণ্ডের ত্রুটি নিয়ে জন্মাচ্ছে, প্রতিবছর কত মানুষ হৃদ্রোগে মারা যাচ্ছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কিছু নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন বেশ কিছু রোগের বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছে। বাংলাদেশসহ প্রায় ২০০টি দেশ নিয়ে তারা গবেষণা করছে। বিভিন্ন ধরনের হৃদ্রোগ-সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান তাদের গবেষণা থেকে পাওয়া যাচ্ছে। রোগের তালিকায় বিভিন্ন ধরনের হৃদ্রোগও আছে। তাদের হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর ২ লাখ ৫ হাজারের বেশি মানুষ হৃদ্রোগে মারা যান। অর্থাৎ দৈনিক ৫৬২ জনের মৃত্যু হচ্ছে হৃদ্রোগে।
অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ২৩ সেপ্টেম্বর উচ্চ রক্তচাপবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৯ লাখ ১৭ হাজার ৩০০ মানুষের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে হৃদ্রোগ ও রক্তনালির (কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ) রোগে মারা যান ২ লাখ ৮৩ হাজার ৮০০ মানুষ। এই পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতিদিন হৃদ্রোগ ও রক্তনালির রোগে ৭৭৭ জনের মৃত্যু হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন দুটি প্রতিষ্ঠানই ২০২১ সালের পরিসংখ্যান দিয়েছে।
হৃদ্রোগ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো সময়ের তুলনায় হৃদ্রোগ শনাক্তের পরীক্ষা এখন দেশে বেশি হচ্ছে। জনবল, যন্ত্রপাতি ও হাসপাতালের সংখ্যা বেড়েছে। পরীক্ষা বেশি হওয়ার কারণে শনাক্ত বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে মানুষের কায়িক শ্রম কমেছে, খেলাধুলার সুযোগ কমেছে, শহর-নগরে মানুষের হাঁটার মতো রাস্তার স্বল্পতা দেখা যাচ্ছে—এসব হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, ‘জাঙ্ক ফুড’ বা অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবারের ব্যবহার বাড়ছে, এসব খাবারে অভ্যস্ত মানুষ হৃদ্রোগের শিকার হচ্ছেন বেশি।
এ পরিস্থিতির মধ্যে আজ দেশে বিশ্ব হার্ট দিবস পালিত হচ্ছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘ডোন্ট মিস আ বিট’। প্রতিপাদ্যে হৃৎস্পন্দন ঠিক রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
পরিসংখ্যানে হৃদ্রোগ
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স আন্ড ইভালুয়েশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে কোনো না কোনো হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে ভুগছেন অনুমিত ১ কোটি ২ লাখ ৬২ হাজার ১৯০ জন। অন্যদিকে দেশে প্রতিবছর নতুন করে ৯ লাখ ৯২ হাজার ৭৩৬ জন হৃদ্রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর অর্থ প্রতিদিন আনুমানিক ২ হাজার ৭২০ জন হৃদ্রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, কমপক্ষে ১১ ধরনের হৃদ্রোগে আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা তাঁরা দেন। সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হন ‘স্কেমিক হার্ট ডিজিজ’-এ। অন্য ধরনগুলোর মধ্যে আছে: কার্ডিওমায়োপ্যাথি অ্যান্ড মায়োকার্ডিটিস, রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ, নন-রিউম্যাটিক ভালভুলার হার্ট ডিজিজ, হাইপারটেনসিভ হার্ট ডিজিজ, অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশান, এন্ডোকার্ডিটিস, অ্যাওর্টিক অ্যানিউরিজম, পালমোনারি অ্যাট্রিয়াল হাইপারটেনশন, লোয়ার এক্সট্রিমিটি পেরিফেরাল আর্টেরিয়াল ডিজিজ ও জন্মগত হৃদ্রোগ। শিশু হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হৃদ্যন্ত্রে ত্রুটি নিয়ে অনেক শিশু জন্ম নেয়। অনেকের হৃৎপিণ্ডে ছিদ্র থাকে। তবে সময়মতো শনাক্ত হলে এবং ঠিকমতো চিকিৎসা হলে এসব শিশু অন্যদের মতো বেড়ে ওঠে।
হৃদ্রোগের ঝুঁকি
উচ্চ রক্তচাপ হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। দেশে হৃদ্রোগে যত মানুষ মারা যায়, তাদের ৫০ শতাংশের বেশি মানুষের উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস থাকে। জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল শাফি মজুমদার বলেন, উচ্চ রক্তচাপ হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশিকে মোটা করে দেয়। এর ফলে হৃদ্রোগের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। অন্যদিকে উচ্চ রক্তচাপের কারণে রক্তনালি সরু হয়ে যায়। এ দুটোই হৃদ্রোগের বড় কারণ।
যারা কম কায়িক শ্রমে অভ্যস্ত, তাদের হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির রোগ, ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বেশি। দেশে ২৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ২৯ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে কম কায়িক শ্রমে অভ্যস্ত। নারীর তুলনায় পুরুষের মধ্যে কায়িক শ্রম কম।
অন্যদিকে একই বয়সী মানুষের ২০ দশমিক ৩ শতাংশ স্থূলকায়। এদের ওজন উচ্চতার তুলনায় বেশি। দেশে পুরুষের তুলনায় নারীর মধ্যে স্থূলতা বেশি দেখা যায়।
দেশে হৃদ্রোগ চিকিৎসার অনেক উন্নতি হয়েছে। হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনসহ দু-একটি জটিল হৃদ্রোগের চিকিৎসা ছাড়া দেশে প্রায় সব ধরনের হৃদ্রোগের আধুনিক চিকিৎসা দেশেই আছে। বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল আছে, যেখানে বিশ্বমানের চিকিৎসা হচ্ছে। তারপরও প্রতিবছর বহু মানুষ হৃদ্রোগ চিকিৎসায় দেশের বাইরে যাচ্ছেন।
দরকার প্রতিরোধ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হৃদ্রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। সুতরাং হৃদ্রোগ যেন না হয়, সেই চেষ্টা জোরদার করতে হবে। এটা প্রমাণিত যে ৮০ শতাংশ হৃদ্রোগ প্রতিরোধযোগ্য। এ জন্য মানুষের মধ্যে এই রোগটির ঝুঁকি ও প্রতিরোধের ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। অন্যদিকে হৃদ্রোগে আক্রান্তদের সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। হৃদ্রোগের আধুনিক চিকিৎসা ঢাকায় কেন্দ্রীভূত না রেখে দেশের জেলা পর্যায়ে পৌঁছানোর উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে।
বেসরকারি ও সরকারি পর্যায়ে ধূমপান নিবারণ, উচ্চ রক্তচাপ কমানোসহ নানা কর্মসূচি আছে। তারপরও হৃদ্রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে। জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, হৃদ্রোগ প্রতিরোধে সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন, লবণ কম খাওয়া ও কায়িক পরিশ্রম বেশি করার দিকে মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আবার শহরাঞ্চলে মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করতে হবে। সমন্বিত উদ্যোগে দেশের তরুণ সমাজকে যুক্ত করতে হবে, কিছু ক্ষেত্রে নেতৃত্বে রাখতে হবে।