দেশে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। প্রতি বছর প্রায় ২২ হাজার রোগী মারা যায়। হেপাটাইটিস সংক্রমণ ক্রমে করোনা মহামারির মতো প্রকট হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, উচ্চঝুঁকিতে থাকা ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। প্রথমে রয়েছে চীন এবং দ্বিতীয় ভারত। এমন পরিস্থিতিতে নতুন প্রজন্মের সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি সুচিকিৎসার সুযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বলেন, বাংলাদেশে হেপাটাইটিসের বি ভাইরাসে ৫ শতাংশ ও সি ভাইরাসে ৮ শতাংশ আক্রান্ত। প্রায় ১৮ কোটি জনগণের মধ্যে প্রায় ১ কোটি আক্রান্ত। এটা এমন ভাইরাস মানবদেহে চুপ করে বসে থাকে। আস্তে আস্তে ভয়ংকর রূপ নেয়। পরবর্তী সময়ে লিভার সিরাসিস ও ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও চিকিত্সাসেবার সুলভ ব্যবস্থা করা দরকার। বাংলাদেশে এক কোর্স ওষুধের মূল্য ৮৫ হাজার টাকা। যেটা ভারতে ৯ হাজার রুপি। ২০৪১ সালে যেহেতু উন্নত বাংলাদেশ হবে, এই নীরব ঘাতকের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করা প্রয়োজন। সারা দেশে হেপাটলজিস্ট আছেন মাত্র ১৬০ জন। গ্যাস্ট্রো এন্ট্রোলজি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন সাড়ে ৫০০। সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হেপাটাইটিসের চিকিৎসার আলাদা ইউনিট চালু করতে হবে। যে কোনো বয়সে মানুষ হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হতে পারে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে এই প্রাণঘাতী রোগ মানবজাতিকে ধ্বংস করে দেবে। কারণ নীরব এই ঘাতক বোঝার আগেই রোগীর জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে হেপাটাইটিস ও গ্যাস্ট্রো লিভারের বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা রয়েছে মহাখালীর শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। এখানে পরীক্ষানিরীক্ষার সব ব্যবস্থা রয়েছে। বিনা মূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়। যে টেস্ট বেসরকারি হাসপাতালে করাতে ১৬ হাজার টাকা, সেটা এখানে ৩ হাজার টাকায় করা যায়। যে পরীক্ষা এখানে ২৫০ টাকায় করা হয়, বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে সেই পরীক্ষা করাতে ৫ হাজার টাকা লাগে। ২৫০ বেডের হাসপাতালটিতে ডাক্তাররা আধুনিক ব্যবস্থায় সুচিকিৎসা প্রদান করছেন। প্রতিদিন এই হাসপাতালে রোগীদের মারাত্মক বেড়ে গেছে। চাহিদার তুলনায় রোগীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় হাসপাতালটিকে ৫০০ বেডে উন্নীত করার জন্য ইতিমধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রস্তাব দিয়েছে। বিষয়টি অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন রয়েছে।
শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম কিবরিয়া বলেন, বর্তমানে হেপাটাইটিসের প্রচুর রোগী আসছে। বেশির ভাগ রোগীকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। বিশ্বমানের চিকিৎসা সব রোগীরা পাচ্ছে স্বল্প খরচে। এটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা—যা বিদেশে মধ্যবিত্তের পক্ষে করা সম্ভব না। সরকারি এই হাসপাতালে প্রতি বছর সময় মতো চিকিৎসা দেওয়ার কারণে হাজার হাজার রোগীর জীবন বেঁচে যাচ্ছে। কারণ শুরুতে রোগ নির্ণয় হলে চিকিৎসায় ভালো হয়ে যায়।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি ৩০ থেকে ৫৪ বছর বয়সীদের। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সময় বেশি আক্রান্ত হয়। বোঝার আগেই সব কিছু শেষ হয়ে যায়। নীরব ঘাতকের মতো। এই বয়সীরা মারা যাওয়ায়, ঐ পরিবারও চরম আর্থিক সংকটে পড়ে। এছাড়া ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবা চালাতে গিয়েও সর্বস্বান্ত হচ্ছে অনেক পরিবার। তাই আমাদের সময় থাকতে এখনি প্রস্তুতি নিতে হবে। যে হারে রোগটা বাড়ছে, সামনে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা অসম্ভব হয়ে যাবে। এই রোগ প্রতিরোধে সব সরকারি হাসপাতালে আলাদা ইউনিট চালু করতে হবে। বিভাগীয় পর্যায়ে আলাদা হাসপাতাল থাকা উচিত। যাতে মানুষ হাতের কাছে চিকিৎসাসেবা পায়। পাশাপাশি এই দেশে ওষুধ তৈরির সক্ষমতা আছে। ইপিআরের মতো টিকা দেওয়া যেতে পারে। টিকা দিয়ে রোধ করা সম্ভব। হেপাটাইটিসের টিকাও আছে, জন্মের পর থেকে টিকা দেওয়া যায়।
যেভাবে হেপাটাইটিস রোগ হয়: অনিরাপদ রক্ত ( পেশাদার ডোনার), সিরিঞ্জ, দৈহিক মিলন, মাদকাসক্ত, একই সিরিঞ্জের মাধ্যমে ড্রাগের ব্যবহার, অনিরাপদ আকুপাঞ্চার, মা থেকে নবজাতকের ছড়াতে পারে। এছাড়া টুথব্রাশ ও সেভিংয়ের উপকরণের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার মানুষ এবং প্রতি ৩০ সেকেন্ডে এক জন হেপাটাইটি বি ও সি—এই দুই ভাইরাসের কারণে মৃত্যুবরণ করে। তবে এই দুটি প্রাণঘাতী ভাইরাস হলেও প্রতিরোধযোগ্য।