'লেডি ডাক্তার' খ্যাত সুনামগঞ্জের প্রথম নারী এমবিবিএস-চিকিৎসক ও সিলেটের মাতৃমঙ্গল হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাকালীন চিকিৎসক ডা. সালেহা খাতুন (৮৮) আর নেই। ২২ মে বুধবার রাতে সিলেট নগরীর কুমারপাড়ায় নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ২৩ মে বৃহস্পতিবার আসরের নামাজের পর সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.) দরগাহস্থ গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে। মৃত্যুকালে তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ বহু আত্মীয় গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
সিলেট অঞ্চলের এই প্রবীণ নারী চিকিৎসকের জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে একটি যুগের পরিসমাপ্তি ঘটলো। তিনি ব্রিটিশ শাসনাধীন পূর্ববঙ্গে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ নভেম্বর তৎকালীন সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমায় জন্মগ্রহণ করেন। সুনামগঞ্জ শহরের আরপিননগরস্থ 'বখত বাড়ি'তে জন্মগ্রহণকারী ডা. সালেহা খাতুনের পিতা মরহুম শাহ বখত ছিলেন একজন পাবলিক সার্ভেন্ট।
ডা. সালেহা খাতুনের কর্মজীবনের একটি বড় অংশ কেটেছে চট্টগ্রাম সরকারি মেডিকেল হাসপাতাল, সুনামগঞ্জ ম্যাটার্নিটি সেন্টার সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য দপ্তরে। তবে কর্মজীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ অতিবাহিত হয়েছে সিলেটের মাতৃমঙ্গল হাসপাতাল কমপ্লেক্সে (রেডক্রিসেন্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র)।
স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নারী চিকিৎসকের স্বল্পতা-যুগে সিলেট শহরে তিন-চারজন ‘লেডি ডাক্তার’ই ছিলেন সিলেট অঞ্চলের বিশেষত সন্তানসম্ভবা মা ও নারী রোগীদের স্বস্তি ও নির্ভরতার স্থান।
সন্তানদের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেও দেশে আসা-যাওয়ার মধ্যেই যাপিত ছিলো জীবনের অন্তিম বছরগুলো। ২০১৫ থেকে দেশেই (সিলেটের কুমারপাড়াস্থ বাসভবনে) কাটিয়েছেন ধর্মকর্মে, একান্তে, অন্তরালবাসিনী হয়ে।
মরহুমার স্বামী মরহুম একে সামস ছিলেন ষাটের দশকে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল। সন্তানদের সবাই (২ ছেলে ১ মেয়ে) যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় সে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেও ডা. সালেহা খাতুনের দেশে আসা-যাওয়ার মধ্যেই কেটেছে জীবনের অন্তিম বছরগুলো। ২০১৫ থেকে স্থায়ীভাবে দেশেই (সিলেটের কুমার পাড়াস্থ বাসভবনে) কাটিয়েছেন ধর্মকর্মে, একান্তে, অন্তরালবাসিনী হয়ে।
মরহুমা সালেহা খাতুন ব্রিটিশ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিবিসিআই, ইউকে) চিফ অ্যাডভাইজার ও ফরমার চেয়ারপার্সন শাহগীর বখত ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুমায়ূন বখতের জ্যেষ্ঠ সহোদরা এবং ব্রড স্ট্রিট ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত লন্ডন সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর শাহান বখত ও ইউএস-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ইউএসবিসিসিআই, ইউএসএ) ভাইস-প্রেসিডেন্ট বখত রোম্মানের বড় ফুফু।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার বর্তমান মেয়র নাদের বখত, অকালপ্রয়াত রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধি মনোয়ার বখত নেক ও মরহুম মেয়র আয়ুব বখত জগলুল এবং বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিন মরহুমার কনিষ্ঠ চাচাতো ভাই।
ডা. সালেহা খাতুন সদ্য অবসরে যাওয়া সিলেটের বিশ্বনাথ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও গীতিকবি সাব্রী সাবেরীনের খালা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে মরহুমার সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণায় তিনি লিখেন, ‘ডা. সালেহা খাতুন আমার বড় খালা। ২০২০ সালে আমার আম্মা কে চিরতরে হারানোর পর দ্বিতীয়বার মাতৃহারা হলাম। 'রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সগিরা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে প্রবীণ এই চিকিৎসকের রুহের মাগফেরাত কামনা করি। দোয়া করি, রাব্বুল আলামীন উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসেবে কবুল করে নিন। আমিন।’
শোক-শ্রদ্ধায় স্মৃতিচারণা
ডা. সালেহা খাতুনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশে ও বিদেশে তাঁর গুণগ্রাহী মহলে শোক ছাড়িয়ে পড়ে। শোক-শ্রদ্ধায় ফেসবুকে অনেকে তা তুলে ধরেছেন। সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য, কবি ও গবেষক মোহাম্মদ সাদিক ছোটবেলায় সিলেট মেডিকেলে চিকিৎসাধীন থাকার সময়ে ডা. সালেহা খাতুনের সান্নিধ্য পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ও বাংলাদেশের প্রথম নারী সলিসিটর জেসমিন আরা বেগম লিখেন, ‘...আমার আম্মার রুবি খালা, আমার তছলিমুন খালাম্মার খুবই কাছের কর্মযোদ্ধা আর আমাদের রুবি আপা ছিলেন তিনি। আরপিন নগর তালুকদার বাড়ীতে উনার মতো শিক্ষিতা মহিলা আর কেউ ছিলেন না। আমরা উনার গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। আমার মায়ের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী। আর উনি একই বছরের নভেম্বর। অথচ বড় গলায় খালা ডাকতেন। উনার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আমারও মাকে ই মনে পড়ছে। আল্লাহ উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের অধিবাসী করুন।’
ডি চৌধুরী অসিত লিখেন, ‘সালেহা আপার জন্য আমরা গভীর শোকাহত। উনার সর্বোচ্চ বেহেশত নসিব হোক। সেইসাথে সুনামগঞ্জ উন্নয়ন সমিতির পক্ষ থেকে মুহিতভাই ও সাবেরীনসহ শোকসন্তপ্ত পরিবারের সকল সদস্য ও আত্মীয়স্বজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।’
‘প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা’ সম্পাদক ও প্রকাশক ইব্রাহিম চৌধুরী শোক ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘ডা. সালেহা খাতুন একজন চিকিৎসকই ছিলেন না। একটা সময়ের উজ্জ্বল প্রতিনিধি ছিলেন। আমার জন্ম আতুড়ঘরে হলেও আমার পরিবারের অনেকের জন্ম এ মাতৃমংগলে। তখন আমাদের শহরেই হাতে গোনা দুই তিনজন নারী চিকিৎসক। তাঁর তত্বাবধানে, তাঁর চিকিৎসায় কতোজনের জন্ম হয়েছে, কতোজনের কাছে সেবা পৌঁছেছে তার কোন শুমার নেই। তাঁর ছেলে জুলকার আমার ক্লাসমেট। আমার বন্ধু। এ মহৎপ্রাণ চিকিৎসকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি সময়ের, একটি ইতিহাসের যবনিকা ঘটেছে। আমাদের সমাজ বদলেছে, মানুষ বদলেছে,চিকিৎসা পেশাও বদলেছে। এ বদলে যাওয়া কতোটা সময়কে ধারণ করে ইতিবাচক পথে ধাবিত, এ নিয়ে আলোচনা ভিন্ন। কথাগুলো মনে পড়ছে এমনিতেই। আমাদের মা চাচী, খালা ফুফুদের প্রিয় চিকিৎসক ডা: সালেহা খাতুনের মৃত্যু আমাদের ব্যক্তিগত শোক। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা। ভালোবাসা ‘
নাসরীন চৌধুরী লিখেন, ‘শ্রদ্ধেয় ডা. সালেহা খাতুনের অবদান সিলেটবাসী চিরকাল মনে রাখবে। কিংবদন্তীতুল্য এই চিকিৎসকের প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করছি। আল্লাহপাক মরহুমাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন এবং তার শোকাহত পরিবারকে ধৈর্যধারণের তৌফিক দিন। আমীন।’
শফিকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘সিলেটে থাকাকালে ব্যক্তিগত ভাবে বেশ ক’বার উনার সাথে দেখা হয়েছে । পেশাগত দায়িত্বের বাইরে সমাজ সেবা মূলক বিভিন্ন কাজের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। প্রবীন এই চিকিৎসক ডঃ সালেহা খাতুন যে সময়ে ডাক্তারী পেশাকে বেছে নেন সেই সময়ে সিলেটে নারী সমাজে মহিলা ডাক্তার ছিলেন হাতে গুনা। মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি সেই শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’
‘আমরার সিলটি আড্ডা’ ফেসবুক পেজে সৈয়দ ইরমানুল হক লিখেছেন, ‘উনার আরেক আপন ভাইয়ের ছেলে ফারহান বক্ত আমাদের খুব কাছে থাকেন, ফারহান বক্তের পরিবার এবং উনার আম্মা সালমা বক্ত চৌধুরীর সাথে আমাদের কয়েকবার যাওয়া আসা হয়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন উনাকে বেহেস্তের উচ্চ মাকাম জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন।’ জুনু চৌধুরী লিখেন, ‘আল্লাহ পাক উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা করুন এই দোয়া করি। আমার আব্বা মরহুম ডা. নিজামুল হক। সেই সুবাদে উনার সাথে আমাদের একটা পারিবারিক সম্পর্ক ছিলো খুবই সুন্দর। আল্লাহ পাক জান্নাতে শান্তিতে রাখুন এবং উনার সন্তান দের সবর দেন এই দোয়া করি। আমিন।’ সৈয়দ মিসবাহ উদ্দিন লিখেছেন, ‘তিনি খুবই ভাল মানুষ ছিলেন। আমাদেরকে খুব স্নেহ করতেন। দু’আ করি মহান আল্লাহপাক যেন খালাকে জান্নাতের মেহমান হিসাবে কবুল করুন, আমিন।’