বর্তমানে ডেঙ্গু একটা বড় সমস্যা। দেশের সর্বত্র ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় দেশে ডেঙ্গুর মৌসুম এখনো পুরোপুরি শুরু হয়নি। তবু প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এ রোগে প্রতি চার দিনে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছর গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে তিন হাজার ৫৪৭ জন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরে এক হাজার ২৬৯ জন ও ঢাকার বাইরে দুই হাজার ২৭৮ জন। অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। চলতি বছর প্রথম ছয় মাসে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৬৫ শতাংশ।
গত বছর এই সময়ে ঢাকার বাইরে রোগী ছিল ২৩.৫০ শতাংশ। ২০২২ সালে ছিল ১২.৪০ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় ঢাকার বাইরে আক্রান্তের হার বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, জুলাই শেষে ডেঙ্গুর প্রকোপ চূড়ায় পৌঁছাবে। বৃষ্টিপাত কম হওয়া এবং তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণে এ বছর ডেঙ্গুর মৌসুম একটু দেরিতে শুরু হচ্ছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় এবং এর সঙ্গে তাপমাত্রা বেশি থাকায় এডিস মশার প্রজনন এখনো বাড়েনি। তবে গত বছরের চেয়ে এ বছর পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হবে না, বরং অবনতির আশঙ্কা বেশি।
মুশতাক হোসেন বলেন, ‘ঢাকার দুই সিটি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যেহেতু কাজ করছে, এর কিছুটা ফল আমরা পাব। তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে একসঙ্গে সারা দেশে কাজটা করতে হবে। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। সিটি করপোরেশন পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। ফলে ঢাকায় যদি সাময়িক সময়ের জন্য মশা কমেও যায়, কিছুদিন পর হয়তো শূন্যস্থান পূরণ হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, কোনো দেশে ডেঙ্গু শুরু হলে এটি শেষ হয়ে যায় না। তবে একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু সে জন্য জরুরি সমন্বিত উদ্যোগ নেই।
তিন বিভাগে ৮৫% রোগী
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের তথ্য মতে, চলতি বছর ঢাকার বাইরে ৮৫ শতাংশ রোগী তিন বিভাগে। সবচেয়ে বেশি ৯৮০ জন আক্রান্ত হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। এই বিভাগের চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও কক্সবাজার জেলায় সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে। এরপর বরিশাল বিভাগের বরিশাল, বরগুনা ও পিরোজপুরে আক্রান্তের হার বেশি। ঢাকা বিভাগের নরসিংদীতে আক্রান্তের হার বেশি।
ঢাকার বাইরে কার্যকর নজরদারি নেই
কীটতত্ত্ববিদ জি এম সাইফুর রহমানের মতে, এ বছর ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হবে জুলাই শেষে আগস্টের শুরুতে। কিন্তু ঢাকায় মশাও থাকবে, ভাইরাসও থাকবে। যারা আক্রান্ত হবে, তাদের ঝুঁকি অনেক বেশি। কারণ তারা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছে। ঢাকায় এর মধ্যে অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে গত বছর যে সেরুটাইপ (ডেঙ্গুর ধরন) ছিল, সেটিরও পরিবর্তন হয়নি।
জি এম সাইফুর রহমান বলেন, ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশ ঢাকার হাসপাতালে হচ্ছে। কিন্তু এসব রোগী প্রকৃত অর্থে ঢাকার কি না, সেটা জানা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী বাড়লেও কার্যকর নজরদারি নেই। আমাদের নজরদারি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি প্রদান, মশক নিধন কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নাগরিকদের সচেতনতা প্রয়োজন।’
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশে গতকাল শুক্রবার (২৮ জুন) সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় কারো মৃত্যু হয়নি। তবে এই সময়ের মধ্যে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯ জন। এর মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭ জন। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালে নতুন করে ভর্তি হয়েছেন আরও ২ জন রোগী।
চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৪৩ জনের। এদের মধ্যে পুরুষ ২০ জন ও নারী ২৩ জন। সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৩ হাজার ৫৪৭ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ২ হাজার ১৪৬ জন ও নারী ১ হাজার ৪০১ জন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ বলেন, গত কয়েক বছরে ঢাকার বাইরের ভাইরাস ও মশা দুটিই বেড়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। সুতরাং আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। সব মিলিয়ে একটা দীর্ঘমেয়াদি ডেঙ্গুচক্রের মধ্যে পড়ে গেছি। আগামী ২০ থেকে ৩০ বছর ডেঙ্গু মানুষকে কষ্ট দেবে, এটা বলা যায়।