পরিবার দিবস

কৈশোরে সন্তান পরিবার থেকে দূরত্ব অনুভব করলে যা করা উচিত

লাইফস্টাইল ডেস্ক
  ১৫ মে ২০২৫, ১৯:৩৭

জন্মের পর একটি শিশুর কোনো নিজস্ব স্মৃতি বা চিন্তা করার ক্ষমতা থাকেনা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে পরিবেশে যা দেখবে, শুনবে ও জানবে তা দিয়েই তার ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়। তােই জন্মক্ষণ থেকেই শিশু তার সামনে রোল মডেল হিসেবে মা-বাবাকেই দেখে। তাদের অনুকরণ করেই বেড়ে উঠতে থাকে।
একসময় শিক্ষাজীবন শুরু হওয়ার পর নতুন নতুন সহপাঠীর সঙ্গে পরিচয়, তাদের ভিন্ন ভিন্ন আচরণ, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষককের মাধ্যমে নানা বিষয়ে শিখতে থাকে। এ ছাড়া সামাজিক পরিবেশ ও প্রকৃতির মাধ্যমেও শিশু প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শিখে। এভাবে যত বয়স বাড়ে তত তার শিক্ষা ও জ্ঞানের পরিধি বড়ে। এভাবেই ১২-১৩ বছর বয়সে সেই শিশুটি বয়ঃসন্ধিতে পা দেয়। যাকে বলা হয় কৈশোরকাল বা টিনএজ।
এ সময় কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এর ফলে তাদের আচরণেও বেশকিছু পরিবর্তন আসে। অনেকক্ষেত্রেই এসব পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অভিভাবকদের বেশ হিমশিম খেতে হয়। এসময় বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের নির্ভরশীলতা কমতে থাকে। তাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতের অমিল হয়, ঘন ঘন মনোমালিন্যও হতে পারে। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই এসময় তারা পরিবার থেকে দূরত্ব অনুভব করে। এসময় সঠিকভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করলে সম্পর্ক ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে।
আজকে পরিবার দিবসে এসব পরিবর্তনের কারণ এবং এমন সময়ে অভিভাবকদের করণীয় নিয়ে ভাবা জরুরি। কেননা সুস্থ পারিবারিক সম্পর্ক সুগঠিত মানুষ তেরিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।
সন্তানের যেসব আচরণে পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব প্রকাশ পায়-

১. মা-বাবার সঙ্গে শেয়ারিং কমে যায়
সন্তান যখন মা-বাবার থেকে দূরত্ব অনুভব করে, তখন তারা ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি শেয়ার করা কমিয়ে দিতে শুরু করে। তাদের কথাবার্তা খুব সাধারণ হয়ে ওঠে এবং প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া পরিবারের সঙ্গে তেমন কথা বলে না।

২. আবেগপূর্ণ কথাবার্তা এড়িয়ে চলে
মা-বাবা বা পরিবারের বড়দের সঙ্গে জীবন, অনুভূতি বা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনার পরিবর্তে তারা সাধারণ কথাবার্তা বলে। যখন অভিভাবকদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে, তখন তারা অনুভব করে, তাদের আগ্রহ, আবেগ বা জীবনযাপন সম্পর্কে বড়রা কোনো জ্ঞান রাখেন না। অথবা বললেও তারা কিছু বুঝবেন না।

৩. মা-বাবার সঙ্গে ভ্রমণে অনীহা
সন্তানেরা মা-বাবার সঙ্গে ভ্রমণ করতে অস্বস্তিবোধ করে। অনীহা থাকার পরও এক রকম বাধ্য হয়ে কর্তব্য মনে করে তারা ঘুরতে যায়।

৪. বন্ধুদের বেশি গুরুত্ব দেয়
এসময় পরিবারের থেকে বন্ধুবান্ধবকে বেশি আপন মনে হয়। যখন কেউ পরিবার থেকে দূরে সরে যায়, তখন সে বন্ধুদের সঙ্গে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় কাটাতে শুরু করে। ব্যক্তিগত জীবনের কোনো বিষয়ে পরামর্শ ও সহানুভূতির জন্যও তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। বন্ধুবান্ধব থাকা খারাপ কিছু নয়, কিন্তু পরিবারের স্থানে বন্ধুদের বসাতে গিয়ে অনেক সময় তারা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে।

৫. অভিভাবকদের কল ধরতে দ্বিধা
একজন কিশোর বা কিশোরী পরিবার থেকে দূরে সরে আসতে শুরু করলে অভিভাবকদের একটি ফোন কলও তাদের কাছে বিরক্তকর মনে হতে পারে। তাই কেউ কল দিলে ইচ্ছে করে দেরিতে ধরে বা কখনো কল রিসিভ করে না।

৬. পারিবারিক আলোচনায় অস্বস্তি অনুভব
পারিবারের সবাই মিলে যখন কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তখন অনেক ক্ষেত্রে তারা এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করে। মতামত প্রকাশের সুযোগ বা কথার গুরুত্ব না পেলে তারা একসময় যোগাযোগে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে।

৭. মা-বাবার পরামর্শ গ্রহণ করতে চায় না
সন্তানের সবচেয় বড় শুভাকাঙ্ক্ষী তার বাবা মা। কিন্তু তাদের থেকে দূরত্ব অনুভব করলে সন্তান অনেক সময় মা-বাবার মতামত ভালোভাবে নিতে পারেনা। অভিভাবকের মতামত যখন তাদের মনমতো হয় না, তখন পরিবারের সিদ্ধান্ত তারা গ্রহণ করতে পারে না। এভাবে চলতে থাকলে পরবর্তীতে কোনো বিষয়ে তারা পরিবারের পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না।
সন্তানের এসব আচরণ মা-বাবার জন্য একটু চ্যালেঞ্জিং। তবে যেহেতু সময়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তাই সন্তানের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য তাদের একটু কৌশলী হতে হবে। ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি সামলে নিতে হবে।

এই পরিস্থিতি সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধন ধরে রাখতে অভিভাবকদের করণীয়-

১. আলাদা মানুষ হিসেবে ভাবুন
টিনএজারদের সঙ্গে মা-বাবার দূরত্ব তৈরি হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, তারা সন্তানদের আগের মতোই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন এবং যা সন্তানরা কোনোভাবেই তা মানতে চায় না। এ সময় তারা কখনো খিটখিটে আচরণ করে, কখনো অত্যন্ত আনন্দিত থাকে, কখনো বা অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসে। এসব আচরণ স্বাভাবিক মনে করে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বিরক্ত হওয়া যাবে না। মনে রাখুন, আপনার সন্তান আর ছোট্ট শিশুটি নেই, সে বড় হচ্ছে। তাকে একজন আলাদা মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করার অর্থ হলো তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতিকে স্বীকৃতি দেওয়া।

২. বন্ধু হয়ে উঠার চেষ্টা করুন
এই বয়সে কিশোর-কিশোরীদের মা-বাবাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়। তাই মা-বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। তবে অনেক অভিভাবক তাদের সঙ্গে আরও বেশি কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণ করেন, আদেশ-উপদেশ দেন – এটি তারা পছন্দ করে না। এতে তাদের ধারণা হয়, মা-বাবা তাদের বোঝেন না।
টিনএজারদের পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলে তাদের মানসিক কষ্ট, ও হতাশায় ভোগার প্রবণতা অনেকটাই কমে যায়।

৩. সন্তানের মতামতের গুরুত্ব
এই বয়সে একজন সন্তান মানসিক, শারীরিক ও আবেগগতভাবে দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। সে নিজের পরিচয় খুঁজে পেতে চায়, সিদ্ধান্ত নিতে শিখে এবং নিজেকে একজন ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। পরিবারের কোনো আলোচনায় তারা যখন কিছু বলতে চায়, সেটা শেষ পর্যন্ত শুনুন। তার কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনা মানে তাকে মূল্য দেওয়া, যা তার আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। তার মতামতের গুরুত্ব দেওয়া না হলে আত্মবিশ্বাস কমে যায়, পরিবার থেকে দূরত্ব তৈরি হয় এবং সে ভুল পথে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।

৪. সীমানা নির্ধারণ করে দেন
সন্তানের কোনো কথায় হুটহাট করে রাগ না করে একটু কৌশলী হোন। বিপদে পড়ার ভয় না থাকলে তারা কিছু করতে চাইলে সেটার অনুমতি দিতে পারেন। তবে কিছু বিষয় নির্ধারণ করে দিন। যেমন-তারা যদি বন্ধুদের সঙ্গে বাহিরে ঘুরতে যেতে চায়, তাহলে কোথায়, কখন এবং কার কার সঙ্গে যেতে পারবে এবং কোন সময় বাড়িতে ফিরতে হবে তার সময় নির্ধারণ করে দেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমনই। তাদের সময়, স্থান, পরিস্থিতি বুঝে তা ব্যবহার করতে দিতে হবে। একেবারে না দেওয়ার কথা চিন্তা করবেন না, এর ফলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

৫. শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, ব্যাখ্যা দিন
কিশোর-কিশোরীর ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে না দিয়ে বরং ভালোভাবে তা ব্যাখ্যা করুন। উপদেশ কমিয়ে আলোচনা বাড়িয়ে দিন। কোন কাজ কেন ক্ষতিকর, কেন আপনি এটি করতে নিষেধ করছেন তার কারণ সুন্দর করে বুঝিয়ে বলুন। এতে তারা বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করবে এবং আপনাকে ভুল বুঝবে না।

৬. সপ্তাহের ছুটিতে ঘুরতে যান
সারা সপ্তাহ নানা ব্যস্ততায় কেটে যায়। এমন পরিস্থিতিতে সন্তানকে সময় দেওয়া হয় না। তাই সাপ্তাহিক ছুটির দিন বা বিভিন্ন দিবসে সন্তানকে নিয়ে ঘুরতে বের হন। তাদের প্রিয় খাবার একসঙ্গে খেতে পারেন। সারা দিন একসঙ্গে আড্ডা ও গল্পে কাটান। নিজেদের শৈশবের স্মৃতিময় ঘটনাগুলো শেয়ার করুন।