ইসলামে সদকাতুল ফিতর বা ফিতরা আদায় করা রমজানের গুরুত্বপূর্ণ একটি আর্থিক ইবাদত। এটি যাকাতেরই একটি শ্রেণি। ফিতরা আররি শব্দ, যা ইসলামে জাকাতুল ফিতর বা সাদাকাতুল ফিতর নামে পরিচিত। ফিতর বা ফাতুর বলতে সকালের খাদ্যদ্রব্য বোঝানো হয়, যা দ্বারা রোজাদাররা রোজা ভঙ্গ করেন। সদকাতুল ফিতর বলা হয় ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরীব দুঃস্থদের মাঝে রোজাদারদের বিতরণ করা দানকে। রোজা বা উপবাস পালনের পর সন্ধ্যায় ইফতার বা সকালের খাদ্য গ্রহণ করা হয়। সেজন্য রমজান মাস শেষে এই দানকে সদকাতুল ফিতর বা সকালের আহারের যাকাত বলা হয়।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা সদকাতুল ফিতরের প্রতি ইঙ্গিত করে ইরশাদ করেছেন- ‘নিশ্চয়ই সাফল্য লাভ করবে সে, যে পরিশুদ্ধ হয়’। (সূরা আলা, আয়াত- ১৪)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সদকায়ে ফিতরকে ফরজ করেছেন- রোজাকে ভুল-ক্রটি থেকে পবিত্রকরণ ও দরিদ্রদের পানাহারের ব্যবস্থা নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে। সুতরাং যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগেই সাদকায়ে ফিতর আদায় করবে, তার ফিতরা মকবুল হিসেবে গণ্য হবে এবং যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পরে আদায় করবে, তার ফিতরা সাধারণ সাদকা হিসেবে গণ্য হবে। (জামেউল ফাওয়ায়েদ- ১/১৪৫)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো ইরশাদ করেছেন, ওই দিন ভিক্ষুকদের ভিক্ষা চাওয়া থেকে মুক্ত করে দাও।
ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় কারও কাছে যাকাতের নিসাবের সমপরিমাণ, অর্থাৎ- সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা অথবা তার সমমূল্যের নগদ অর্থ কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অতিরিক্ত কিছু সম্পদ যদি বিদ্যমান থাকে, তাহলে তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে। যার ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব, তিনি নিজের পক্ষ থেকে যেমন আদায় করবেন, তেমনি নিজের অধীনস্তদের পক্ষ থেকেও আদায় করবেন। তবে এতে জাকাতের মতো বর্ষ অতিক্রম হওয়া শর্ত নয়। (ফাতহুল কাদির- ২/২৮১ পৃষ্ঠা)।
নারী-পুরুষ, স্বাধীন-পরাধীন, শিশু-বৃদ্ধ, ছোট-বড় সব মুসলিমের জন্য সদকায়ে ফিতর প্রদান করা ওয়াজিব। সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়া মাত্রই তা আদায় করতে হবে, নাকি পরে করলে চলবে? এ ব্যাপারে বাহরুর রায়েক কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে- সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা আদায় করা উত্তম। (আল বাহরুর রায়েক- ২/২৫১ পৃষ্ঠা)।
ঈদের দিনের পূর্বে সদকায়ে ফিতর দেওয়া জায়েয। রাসূলুল্লাহ (সা.)এর যামানায় সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিনের আগেই সদকায়ে ফিতর আদায় করে দিতেন। (আল বাহরুর রায়েক- ২/২৫১)।
যেসব মুসলমানের এই পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, যার মূল্য এই পরিমাণ হয় যে, তার ওপর জাকাত ওয়াজিব হবে, তাহলে তার ওপর ঈদের দিন সদকায়ে ফিতর দেওয়া ওয়াজিব, চাই সে সম্পদ ব্যবসায়ের হোক বা না হোক এবং পূর্ণ এক বৎসর অতিবাহিত হোক বা না হোক। শরীয়তের বিধান অনুযায়ী এ সাদকাকে সাদকায়ে ফিতর বলা হয়। (হাশিয়ায়ে তাহ্তাবী- ৩৯৪ পৃষ্ঠা)।
যে ব্যক্তি কোনও কারণবশতঃ রোযা রাখতে পারেনি, তার ওপরও সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। যে রোজা রেখেছে তার উপরও ওয়াজিব। যে শিশু সন্তান ঈদের দিন সুবহে সাদিক হওয়ার পর জন্ম গ্রহণ করেছে, তার পক্ষ থেকে সাদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। কিন্তু যে শিশু সুবহে সাদিকের পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেছে, তার পক্ষ থেকে সাদকায়ে ফেতর আদায় করা সক্ষম অভিভাবকের ওপর ওয়াজিব। (আলমগীরী- ১/১৯২ পৃষ্ঠা)।
সদকা ফিতিরের পরিমাণ হচ্ছে, আটা, গম বা গমের ছাতু হলে অর্ধ সা। (নূরুল ইযাহ- ৩৯৫)। অর্থাৎ- আটা, গম বা গমের ছাতু বর্তমান প্রচলিত মাপে এক কেজি ৬৩৫ গ্রামের সামান্য বেশি অথবা তার সমপরিমাণ মূল্য দিতে হবে। তবে আদায়ের ক্ষেত্রে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে কিছু বেশি দেওয়াই উত্তম। খেজুর, যব অথবা কিসমিস দিলে গম ইত্যাদির দিগুণ তথা ৩ কেজি ২৭০ গ্রামের সামান্য বেশি বা তার সমপরিমাণ মূল্য দিবে। (বেহেশতী জেওর- ২/২৩০)।
উল্লেখ্য, আমাদের দেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষণা মতে, ‘এক সা’-এর পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়, তিন কেজি ৩০০ গ্রাম। আর ‘আধা সা’-এর পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়, এক কেজি ৬৫০ গ্রাম।
কেউ এসব খাদ্য সামগ্রী ছাড়া অন্য কিছু যেমন চাল ইত্যাদি দিতে চাইলে, হিসেব করে খেজুর, গম, যব, কিসমিস ইত্যাদির সমপরিমাণ মূল্য আদায় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গমের ওপর অনুমান করে তার সমপরিমাণ চাল দিলে তা জায়েয হবে না। কেননা ফিকহের কিতাবে বলা হয়েছে, হাদীসে যে সব জিনিস দেওয়ার কথা সরাসরি উল্লেখ রয়েছে এসবের মূল্য দিতে হবে। ফিকাহবিদগণ বলেন, গম প্রভৃতির মূল্য দেওয়াই উত্তম। আর যে সব জিনিস দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে, তার মূল্য দেওয়াই উত্তম। (ফাতওয়া আলমগীরী- ১/১৯২)।
একজনের ফিতরা একজন অথবা একাধিক মিসকিনের মধ্যে বণ্টন করে দিতে পারবে। (মারাকীউল ফালাহ- ৫৯৬)।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাযি.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) একজন ঘোষক প্রেরণ করলেন, সে যেন মক্কার পথে পথে এ ঘোষণা করে যে, জেনে রেখো, প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, গোলাম-স্বাধীন, ছোট-বড় প্রত্যেকের ওপর সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য। দুই মুদ (আধা সা) গম কিংবা এক সা অন্য খাদ্যবস্তু। (তিরমিযী, হাদিস- ৬৭৪)।
ঈদগাহে যাওয়ার আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করা সর্বোত্তম। কারণ এর মাধ্যমে ধনী-গরিবের মাঝে আনন্দের ভাগাভাগি হয়। তাছাড়া এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাতও। ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, সুন্নাত হলো ঈদের নামাযে যাওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করা। (আল-মুজামুল কাবির, হাদিস- ১১২৯৬)।
ইবনে ওমর (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) আমাদের ঈদগাহে যাওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। (বুখারি, হাদিস- ১৫০৯)।
তবে কারো যদি কোনও কারণবশত ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করা সম্ভব না হয়, তাহলে পরে আদায় করারও সুযোগ রয়েছে।
হাদিসে উল্লিখিত পাঁচটি দ্রব্যের যেকোনও একটি দ্রব্য বা এর মূল্য আদায়ের মাধ্যমে সদকাতুল ফিতর আদায়ের সুযোগ দিয়েছে ইসলামী শরিয়ত। এর কারণ হচ্ছে, মুসলিমরা যেন নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী যেকোনও একটির মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে তা আদায় করতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে সামর্থ্যবানরাও ব্যাপকভাবে সর্বনিম্ন দ্রব্যের মূল্য ধরে তা আদায় করে থাকে, যা বাস্তবিকই হতাশাজনক। কারণ, হাদিস শরিফে এসেছে, একবার রাসূলুল্লাহ (সা.)কে সর্বোত্তম দান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ইরশাদ করেন, ‘দাতার নিকট যা সর্বোৎষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি, সেটাই উত্তম’। (বুখারি, হাদিস- ২৫১৮)।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক মুঈনুল ইসলাম