কোরআনের বর্ণনায় হজরত ঈসার (আ.) জন্ম

ধর্ম ডেস্ক
  ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:০৪

হজরত ঈসার (আ.) মা হজরত মারিয়ামকে (আ.) যখন তার মা গর্ভে ধারণ করেন, তখন তিনি নিজের গর্ভের সন্তানকে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন তার ছেলে সন্তান হবে। সন্তান জন্মের পর তিনি যখন দেখলেন আল্লাহ তাকে মেয়ে সন্তান দান করেছেন, তখন তিনি কিছুটা হতাশ হন। কিন্তু আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ছিল এই মেয়েই আল্লাহর বিশেষ বান্দা হবে এবং বহু পুরুষের চেয়ে বেশি সম্মানিত হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ইমরানের স্ত্রী যখন বললো, হে আমার পালনকর্তা! আমার গর্ভে যা রয়েছে আমি তাকে তোমার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত রেখে। আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও, নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞাত। অতঃপর যখন তাকে প্রসব করলো বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমি কন্যা প্রসব করেছি। সে কী প্রসব করেছে আল্লাহ তা ভালই জানেন। সেই কন্যার মত কোনো পুত্রই যে নেই। আমি তার নাম রাখলাম মারিয়াম। (মারিয়ামের মা দোয়া করলেন, হে আল্লাহ!) আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে তোমার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি অভিশপ্ত শয়তানের কবল থেকে। (সুরা আলে ইমরান: ৩৫, ৩৬)
আল্লাহর নবি হজরত জাকারিয়া (আ.) মারিয়ামের (আ.) আত্মীয় ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি তার প্রতিপালনের দায়িত্ব লাভ করেন। মারিয়াম (আ.) তার কাছে প্রতিপালিত হন। তার দায়িত্বে ও দেখাশোনায় থেকেই মারিয়াম (আ.) বায়তুল মুকাদ্দাসের খেদমত করতে থাকেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, অতঃপর তার পালনকর্তা তাকে উত্তমভাবে গ্রহণ করে নিলেন এবং তাকে প্রবৃদ্ধি দান করলেন-অত্যন্ত সুন্দর প্রবৃদ্ধি। তাকে জাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে সমর্পন করলেন। যখনই জাকারিয়া মেহরাবে তার কছে আসতেন, তখনই কিছু খাবার দেখতে পেতেন। জিজ্ঞেস করতেন মারিয়াম! কোথা থেকে এসব তোমার কাছে এলো? তিনি বলতেন, এসব আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিজিক দান করেন। (সুরা আলে ইমরান: ৩৭)

একদিন মারিয়াম (আ.) বায়তুল মুকাদ্দাসের পাশে এক খেজুর বাগানে ছিলেন। তখন জিবরাইল (আ.) মানুষ বেশে তার কাছে আসেন। তাকে হজরত ঈসার (আ.) জন্মের সুসংবাদ দেন। তিনি মারিয়ামের (আ.) জামায় বা মুখে ফুঁ দেন এবং আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় মারিয়াম (আ.) কোনো মানুষের স্পর্শ ছাড়াই অন্তঃসত্ত্বা হন।

এই ঘটনা বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলেন, আপনি এই কিতাবে মারিয়ামের কথা বর্ণনা করুন। যখন সে তার পরিবারের লোকজন থেকে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে একস্থানে আশ্রয় নিল। সে তাদের থেকে আড়াল করার জন্য পর্দা টাঙিয়ে নিল। তখন আমরা তার কাছে আমাদের রূহকে (অর্থাৎ জিবরাইলকে) প্রেরণ করলাম। সে তার কাছে মানুষের আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল। মারিয়াম বলল, আমি তোমার থেকে করুণাময় আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যদি তুমি আল্লাহভীরু হও। সে বলল, আমি তো তোমার প্রভুর প্রেরিত। আমি তোমাকে একটি পবিত্র পুত্র সন্তান দান করে যাব। মারিয়াম বলল, কিভাবে আমার পুত্র সন্তান হবে? অথচ কোনো মানুষ আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণী নই। সে বলল, এভাবেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজ ব্যাপার এবং আমরা তাকে (ঈসাকে) মানবজাতির জন্য একটি নিদর্শন ও আমাদের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহরূপে সৃষ্টি করতে চাই। এটা (পূর্ব থেকেই) নির্ধারিত বিষয়। (সুরা মারিয়াম: ১৬-২১)

তারপর হজরত ঈসাকে (আ.) জন্মদানের ঘটনা বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলেন, তারপর মারিয়াম গর্ভে সন্তান ধারণ করল এবং তাকেসহ একটু দূরবর্তী স্থানে চলে গেল। এক পর্যায়ে প্রসব বেদনা তাকে একটি খেজুর গাছের মূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। তখন সে বলল, হায়! আমি যদি এর আগেই মারা যেতাম এবং আমি যদি মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম। তখন একজন ফেরেশতা তাকে পার্শ্ববর্তী নিম্নভূমি আওয়াজ দিয়ে বলল, তুমি দুঃখ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পায়ের নিচে একটি ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করেছেন। তুমি খেজুর গাছের কান্ড ধরে নিজের দিকে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার ওপর সুপক্ক খেজুর পড়বে। তুমি আহার কর, পান কর এবং নিজের চোখ শীতল কর। আর যদি কোনো মানুষকে তুমি দেখ, তবে তাকে বলে দিয়ো যে, আমি দয়াময় আল্লাহর জন্য রোজা পালনের মানত করেছি। তাই আমি আজ কারো সাথে কোনো কথা বলব না। (সুরা মারিয়াম: ২২-২৬)

হজরত ঈসাকে আল্লাহ তাআলা তার নবি হিসেবে পাঠিয়েছিলেন এবং জন্মের পরপর শিশু অবস্থায়ই অনেক মুজিজা বা অলৌকিক ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্যও তাকে দান করেছিলেন, যেন মানুষ বুঝতে পারে তিনি আল্লাহর প্রেরিত নবি এবং তার মা পুণ্যবতী মারিয়াম সম্পর্কে কোনো অযাচিত ধারণা পোষণ না করে।
তার একটি অলৌকিক বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি কথা বলার বয়স হওয়ার আগেই মানুষের সাথে কথা বলেছিলেন। কোরআনে হযরত ঈসার (সা.) এই অলৌকিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, স্মরণ কর, যখন ফেরেশতারা বলল, হে মারিয়াম, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে তাঁর পক্ষ থেকে একটি কালেমার সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার নাম মসিহ ঈসা ইবনে মারিয়াম, যে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত এবং নৈকট্যপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত। সে মানুষের সাথে কথা বলবে দোলনায় ও পরিণত বয়সে এবং সে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত। (সুরা আলে ইমরান: ৪৫, ৪৬)
তার মা মারিয়াম (আ.) যখন তাকে নিয়ে তার আত্মীয় স্বজনের কাছে আসেন, তারা শিশু ঈসার পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে, মারিয়ামকে (আ.) দোষারোপ করতে থাকে। মারিয়াম (আ.) তখন নিজে চুপ থেকে কোলের শিশুকে ইশারায় দেখিয়ে দেন যে আপনারা তাকেই তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন। তারা বলে, আমরা এতটুকু একটা বাচ্চার সাথে কীভাবে কথা বলবো! ঈসা (আ.) তখন বলে ওঠেন, আমি আল্লাহর বান্দা; তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আমাকে নবি বানিয়েছেন, যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন এবং যতদিন আমি জীবিত থাকি তিনি আমাকে সালাত ও যাকাত আদায় করতে আদেশ করেছেন। আর আমাকে মায়ের প্রতি সদাচারী করেছেন, উদ্ধত ও অহংকারী করেননি। আর আমার ওপর শান্তি যেদিন আমি জন্মেছি, যেদিন আমি মারা যাব এবং যেদিন পুনরায় জীবিত করে আমাকে ওঠানো হবে। (সুরা মারিয়াম: ৩০-৩৩)