তুরস্কে আন্তর্জাতিক হাদীস গবেষণা, প্রকাশনা ও ইজাযত মেরাসিম অনুষ্ঠিত

আবদুল্লাহ হাশেম
  ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:৩৬

গত ১৯ জানুয়ারি ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক সোলাইমানিয়া জামে মসজিদে ইবনে খালদুন ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে “নবীজির সুন্নত ও সীরাতের পুনর্জীবন” শীর্ষক আন্তর্জাতিক হাদীস ও সীরাত গবেষণা, প্রকাশনা এবং ইজাযত প্রদান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। উক্ত সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ, সোলাইমানিয়া দারুল হাদীসের শায়খ, আল্লামা মোহাম্মদ আওয়ামাহ, তুরস্কের মাননীয় প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান, তুর্কি ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রনালয় এবং উচ্চশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের প্রধানগণ, বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বরেণ্য উলামা, মাশায়েখ, তালেবুল ইলম এবং শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ।
তিনটি বিশেষ উপলক্ষ্যকে সামনে রেখে এই প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়-
(১) শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ হাফিজাহুল্লাহ এর তত্ত্বাবধানে বিখ্যাত হাদীসগ্রন্থ তিরমিজি শরীফের তাহকিক ও তাওসিককৃত (সম্পাদিত ও দালিলিক) বিশেষ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন।
(২) প্রসিদ্ধ সীরাতগ্রন্থ ইমাম ক্বাসত্বল্লানী (রাহি.) এর “মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়্যাহ”, এবং তদীয় ব্যখ্যাগ্রন্থ শারহুল জুরক্বানী এর তাহকিক ও তাওসিক কার্যক্রমের উদ্বোধন।
(৩) শায়খের দীর্ঘ সাত বছর ধরে চলমান ইমাম সুয়ুতী (রাহি.) এর “তাদরিব আল-রাওয়ী” কিতাবের পাঠ ও ব্যাখ্যা সমাপ্তি উপলক্ষ্যে ইজাযত প্রদান।
তিরমিজি শরীফের তাহকিক ও তাওসিককৃত বিশেষ নুসখাটি বারো (১২) খণ্ড বিশিষ্ট। এটি ছিলো ইবনে খালদুন ইউনিভার্সিটির হাদিস রিসার্চ সেন্টারের পক্ষ থেকে শায়খ আওয়ামাহ এর গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদীস প্রজেক্ট। শায়খের তত্ত্বাবধানে গবেষক আলেমদের একটি দল দীর্ঘ চার বছরের প্রচেষ্টায়
কাজটি সমাপ্ত করেন। গবেষক দলটির একজন সদস্য, বাংলাদেশী আলেম, মাওলানা আতাউল্লাহ হাশেম জানান, এটি হাদীস শাস্ত্রের একটি অনন্য সংযোজন হতে যাচ্ছে ইনশাআল্লাহ। এর প্রথম দুই খন্ড শায়খের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অর্ধশতাব্দীরও অধিক কালব্যাপী শাস্ত্রীয় গবেষণা ও অনুশীলনের
সার-নির্যাস। সাইন্স অব হাদীস ও ইসলামিক স্টাডিজের ছাত্র, শিক্ষক, গবেষকগণ সুনান আল- তিরমিজির মতো হাদিসের গুরুত্বপূর্ণ আকর গ্রন্থের যেরুপ সমৃদ্ধ এডিশনের প্রতিক্ষায় ছিলেন তা এই নুসখা পূরণ করবে বলে তিনি বিশ্বাসী। অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে এর লিমিটেড কপি প্রস্তুত করা
হলেও শীঘ্রই তুরস্ক এবং বহির্বিশ্বে এটি পাওয়া যাবে বলে তিনি জানান।
সম্মেলনের দ্বিতীয় ধাপে শায়খের তত্ত্বাবধানে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত বা জীবনীর উপর বিখ্যাত গ্রন্থ, শারহুল জুরক্বানীসহ ইমাম ক্বাসত্বল্লানী (রাহি.) এর “আল মাওয়াহিব আল লাদুন্নিয়্যাহ" এর তাহকিক ও তাওসিক কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়।
হাদীসশাস্ত্রের পর সীরাতশাস্ত্রের উপর এটি শায়খ আওয়ামাহ এর আরেকটি বিশেষ প্রজেক্ট। কাজ সমাপ্তির পর কিতাবটি পঁচিশ (২৫) খণ্ডেরও বেশী সুবৃহৎ কলেবর ধারণ করতে পারে বলে জানান টিম সংশ্লিষ্ট আতাউল্লাহ হাশেম। নবীজির পবিত্র সীরাতের উপর রচিত কিতাবটি প্রামাণ্য একটি গ্রন্থ
হিসেবে বোদ্ধামহলে জায়গা করে নিবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
সম্মেলনে সাইন্সেস অফ হাদীসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্রীয় গ্রন্থ, ইমাম সুয়ুতী (রাহি.) এর "তাদরিব আল-রাওয়ী ফি শারহি তাক্বরিব আল-নববী” এর পাঠ ও ব্যাখ্যা সমাপ্তি উপলক্ষে শায়খ আওয়ামাহ এর পক্ষ থেকে দরসে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে পঁচিশজন আলেমকে ট্রাডিশনাল ইজাযত
প্রদান করা হয়। ইজাযতপ্রাপ্ত বিরল সম্মাননার অধিকারী আলেমদের মধ্যে তুরস্ক, পাকিস্তান, সিরিয়া, জর্দান, উজবেকিস্তান সহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক ছিলেন। বাংলাদেশ থেকে আতাউল্লাহ হাশেম উক্ত ইজাযতে ভূষিত হন। এই দরসটি মূলত ইবনে খালদুন ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে ইস্তাম্বুলে বসবাসরত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদিস বিভাগের শিক্ষক ও গবেষক আলেমদের কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। শায়খ আওয়ামাহ ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘ সাত বছর যাবত কিতাবটির উপর পাঠ এবং ব্যাখ্যা প্রদান করেন। সম্মেলনে উপস্থিত সূধীগণ এর মাধ্যমে কিংবদন্তীতুল্য এই মুহাদ্দিসের শাস্ত্রীয় উত্তরাধিকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে বিস্তার লাভ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এ সময় ইজাযতপ্রাপ্ত আলেম ও গবেষকদেরকে প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব
এরদোয়ানের পক্ষ থেকে তাঁর স্বাক্ষর ও প্রেসিডেনশিয়াল প্রতিক সম্বলিত বিশেষ উপহার প্রদান করা হয়। স্থানীয় সময় সকাল দশটায় ঐতিহাসিক সুলাইমানিয়ে জামি’তে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে আরম্ভ হওয়া অনুষ্ঠানটি ইবনে খালদুন ইউনিভার্সিটি, আনাদুলু এজেন্সি সহ বিভিন্ন পেইজ ও
চ্যানেল থেকে লাইভ সম্প্রচারীত হয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান তাঁর বক্তব্যে সম্মেলনে উপস্থিত দেশী-বিদেশী উলামা মাশায়েখ, ও নেতৃবৃন্দকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেনঃ
আজকের অনুষ্ঠান আমাদের পূর্বসুরীগণ কর্তৃক আলেমদের গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজের শুরু বা সমাপ্তি উদযাপনের ঐতিহ্যকে আবার ফিরিয়ে আনলো। তিরমিজি শরীফের উপর শায়খ আওয়ামাহ এর অসাধারণ এই কাজের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করে বলেন, উসমানী খলিফা দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের
নির্দেশে তৎকালীন শায়খুল আযহারের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ আলেমদের মাধ্যমে সহীহ বুখারীর যে সুলতানী এডিশন প্রস্তুত করা হয়েছিলো, সেটির মতোই সুনান আল-তিরমিজির এই নুসখাটিও একটি প্রামাণ্য এডিশন হিসেবে বিবেচিত হবে ইনশাআল্লাহ। এ সময় তিনি শায়খ আওয়ামাহ এর
তত্ত্বাবধান ও পরিচালনায় “ইন্টান্যাশনাল সুন্নাহ অ্যান্ড সিয়ার আল-নাবাওইয়্যাহ রিসার্চ সেন্টার” প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। প্রান্তিকতা বিবর্জিত ভাবে আহলে সুন্নাহর সঠিক মানহাজের উপর অটল থেকে হাদীস ও সুন্নাহর গবেষণায় জীবন উৎসর্গ করার জন্য প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান
শায়খ আওয়ামাহ এর প্রতি আন্তরিক মোবারকবাদ জ্ঞাপন করেন। সেই সাথে ইজাযতপ্রাপ্ত উলামায়ে কেরাম, সুনান আল-তিরমিজির কাজের সাথে সংশ্লিষ্টদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে সবাই যেন সুস্থতার সাথে পবিত্র রমজান মাসে উপনীত হতে পারে সে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এবং গাযযাহসহ
পৃথিবীর দিকে দিকে নির্যাতিত মুসলিমদের জন্য দোয়ার অনুরোধ জানান।
অন্যদিকে তুরস্কের ধর্মমন্ত্রী ডক্টর আলী এরবাস তাঁর বক্তব্যে বলেন, ইবনে খালদুন ইউনিভার্সিটির এ সকল গবেষণা প্রকল্প নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সুন্নত এবং সীরাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করবে।উপসাগরীয় দেশসমূহের শরীয়া স্কলার্স এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট আজিল আল নাশমী তাঁর শুভেচ্ছা বক্তব্যে মাননীয় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, শায়খ মোহাম্মদ আওয়ামাহ এর প্রজেক্টগুলো মুসলিমবিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বিগত ইলমী কাজগুলো এর সাক্ষ্য
দেয়, যার সবগুলোই আহলে ইলমদের নিকট বহুল সমাদৃত।
তুরস্কের সাবেক ধর্মমন্ত্রী ডক্টর মেহমেত গরমেজ তাঁর ভাষণে বলেন, ঐতিহাসিক সোলাইমানিয়্যাহ জামে মসজিদ তার আসল পরিচয় ও ইতিহাস তুলে ধরছে। এবং সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে ইস্তাম্বুলে উলামায়ে কেরামের ব্যাপক উপস্থিতি দেশের জন্য কল্যান ও রহমতের উসিলা। একই সাথে তিনি হাদিস বর্ণনাকারীদের একটি সোনালী ধারা: "ইমাম মালিক, তাঁর উস্তাদ নাফি' (রাহি.) থেকে, তিনি হযরত ইবনে উমার (রা:) থেকে", এর মতই আমাদের যুগে: "শায়খ আওয়ামা, তদীয় উস্তাদ শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ থেকে, এবং তিনি শায়খ যাহিদ আল-কাউসারী থেকে" ইলমী সিলসিলার সেই স্বর্ণালী ধারার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন। ইবনে খালদুন ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, অধ্যাপক ডক্টর ইরফান গুন্দুজ বলেন, যারা আমাদের থেকে আমাদের মূল পরিচয়কে আলাদা করে ফেলতে চায়, আজকের অনুষ্ঠান,
বাস্তবায়িত ও পরিকল্পনাধীন হাদীস এবং সীরাত প্রকল্পগুলো তাদের বিরুদ্ধে উত্তম জবাব। প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ডক্টর মহিউদ্দিন আওয়ামা তিনটি প্রকল্পেরই বিস্তারিত পরিচিতি ও কার্যপদ্ধতি তুলে ধরেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ট্রাস্টি বোর্ডকে গবেষণা কার্যক্রমে তাঁদের অব্যাহত সাপোর্টের জন্য ধন্যবাদ জানান।
উপস্থিত সূধীজনদের মাঝে ইরাকের বিখ্যাত আলেম, শায়খ আবদুল মালিক আল-সা’দি, ইয়ামানের প্রভাবশালী ইলমি ব্যক্তিত্ব শায়খ আব্দুল মাজিদ আল-জিন্দানী, সিরিয়ান দা’য়ী শায়খ মুহাম্মাদ রাতেব আল-নাবলুসী, মৌরিতানিয়ান স্কলার শায়খ হাসান আল-দাদ্দু, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ
মুসলিম স্কলার্শের সহ-সভাপতি ডক্টর ইসাম আল-বাশীর, ভারতের নদওয়াতুল উলামার রেক্টর সায়্যিদ বিলাল আল-হাসানী আল-নদভী, উজবেকিস্তানের রিলিজিয়ার্স এফেয়ার্সের প্রধানসহ প্রমূখ বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বগণ উপস্থিত ছিলেন। প্রায় তিন ঘন্টাব্যাপী মোবারক মজলিসটি জুমার সালাত ও দোয়ার মাধ্যমে সমাপ্ত হয়।
লেখক-
আবদুল্লাহ হাশেম
ছাত্র, আল-আজহার ইন্সটিটিউট, মিশর।