পবিত্র কাবা শরীফ তাওয়াফ

ফজলুর রহমান চৌধুরী
  ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:৫২

পবিত্র হজ্ব শুরুর আগে প্রথম ওমরাহ আদায় করার জন্য আমরা ৫০/৬০ জনের কাফেলা বাদ এশা মোয়াল্লেম সাহেব , তাদের প্রতিনিধির নেতৃত্বে ইহরাম বাধা অবস্থায় কাবা ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। বিভিন্ন মাধ্যমে কাবা শরীফের অনেক ছবি দেখেছি। কাবা বায়তুল্লাহ মসজিদের ভিতরে যখন পবিত্র কাবা ঘর হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল তখন মন প্রাণ চমকে উঠে। আল্লাহ হুআকবার বলে আওয়াজ তুলি।আমরা কাবা ঘরের খুব কাছে  সবুজ বাতি পয়েন্ট থেকে হাজরে আসওয়াদ পাথরের দিকে হাত ইশারায় আল্লাহুআকবার বলে তাওয়াফ শুরু করি।এবং তালবিয়া, দোয়া দুরুদ, তওবা(আস্তাগফার) পড়তে পড়তে তাওয়াফ সম্পন্ন করি। ঘরির কাটার উল্টো দিকে বাম থেকে ডান দিকে ঘুরতে হয়। এক তাওয়াফ শেষ করে হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) দুর থেকে ইশারায় হাত তুলে বিছমিল্লাহে আল্লাহু আকবার বলি। মোয়াল্লেম সাহেব আনোয়ার ভাই পূর্বেই সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন এ হজ্ব মৌসুমে কালো পাথর কাছে গিয়ে স্পর্শ করে চুম্বন দেয়ার চেষ্টা যেন না করি। মহাবিপদ হতে পারে।আল্লাহর রহমতে অন্য কোনো হালকা সময়ে চুম্বন করার চেষ্টা করা যাবে। স্ত্রীর হাত শক্ত করে ধরে তাওয়াফ করছি। অন্যরাও যার যার নারী বা  পুরুষের হাত বা পিছনের ঝুলানো ব্যাগ ধরে ঘুরছেন।আমাদের সবার পিছনে একই কমলা কালারের ব্যাগ ঝুলানো। মাঝে মাঝে অন্য কাফেলার হাজ্বীগণের ধাক্কায় গ্রুপ থেকে সরে আসলেই আমাদের প্রতিনিধি ডানে, বামে বা সামনে দ্রুত সরে যেতে পরামর্শ দেন। সাহায্য করে গ্রুপের ভিতর ঢুকিয়ে দেন যাতে হারিয়ে না যাই।মাঝে মাঝে এমন ভিড়ে পড়তে হয় দম ফেলবার যায়গা নেই যেন। খুবই শক্তি সঞ্চয় করে বড় বড় শক্তিশালী মানুষের ধাক্কা, চিপা খেয়ে টিকে থাকতে হয়।এক সময় মোকামে ইব্রাহীম কাছে গিয়ে স্পর্শ করে দেখতে পেরেছি। কালো পাথরে আমরা স্পর্শ করে চুমো দিতে সুযোগ না পেলেও সর্বদা কোনো না কোন বড় শক্তিশালী কালো মানুষকে পুলিশের পাশে এ পাথর স্পর্শ করতে দেখা গিয়েছে।
সাতবার প্রদক্ষিণ/ তাওয়াফ শেষ করে আমরা একসাথে সেই সবুজ বাতি বরাবর মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করি। দু রাকআত নফল শোকরানা নামাজ আদায় করতঃ দোয়া করে জমজমের পানি পান করি।সেখান থেকেই  উপরে উঠে সাফা -মারওয়া পাহাড় (সাঈ) সাত বার আসা যাওয়া করি। মাঝপথে সবুজবাতি এলাকায় পুরুষগণ দৌড় দিয়ে পার হতে হয়।

ওমরাহ শব্দের আভিধানিক অর্থ জিয়ারত করা, পরিদর্শন করা ও সাক্ষাৎ করা। পবিত্র কাবাগৃহের জিয়ারতই মূলত ওমরাহ। ইসলামের ভাষায় পবিত্র হজের সময় ছাড়া অন্য যেকোনো সময় পবিত্র কাবাঘরের তাওয়াফসহ নির্দিষ্ট কিছু কাজ করা অর্থাৎ ইহরাম, তাওয়াফ, সাঈ ও মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করার মাধ্যমে বায়তুল্লাহ শরীফের জিয়ারত করাকে ওমরাহ বলা হয়। ওমরাহ পালনে প্রধানত চারটি কাজ। দুইটি কাজ ফরজ— (ক.) ইহরাম পরিধান করা। (খ.) পবিত্র কাবাগৃহ তাওয়াফ করা। আর দুইটি কাজ ওয়াজিব— (ক.) সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী (সবুজ বাতি) স্থানে সাতবার সাঈ করা। (খ.) মাথার চুল মুণ্ডানো বা ছোট করা। ওমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত ইবাদত। জানা যায় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনে চারবার ওমরা পালন করেছেন। তবে ওমরা করা আবশ্যক না হলেও তা পালন করা উত্তম।

১. ইহরাম বাধা
ওমরার জন্য ইহরাম বাধা ফরজ। তাই নির্ধারিত মিকাত থেকে পুরুষরা সেলাইবিহীন দুটি কাপড় পরে ওমরার জন্য ইহরামের নিয়ত করবে।মহিলারা পর্দাসম্মত স্বাভাবিক কাপড় পড়ে এ নিয়ত করবেন। ইহরাম পরিধানের আগে বেশ কিছু করণীয় আছে। এগুলো হলো—ইহরাম পরিধানের আগে সব ধরনের শারীরিক পরিচ্ছন্নতা অর্জন করতে হবে। যেমন—হাত-পায়ের নখ কাটা, গোঁফ, চুল ও নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করা ইত্যাদি। ইহরাম পরিধানের আগে গোসল করা সুন্নত। অনেকে গোসল ও সুগন্ধি ব্যবহারের পর ইহরামের কাপড় পরিধান করেন।মিকাত (ইহরামের জন্য নির্দিষ্ট স্থান) বা তার আগে ওমরাহর নিয়ত করতে হবে। মক্কায় আয়েশা(রাঃ)মসজিদ থেকে ইহরাম বাধা যায়।এরপর তালবিয়া পড়তে হবে।
ফরজ নামাজের ওয়াক্ত হলে ফরজ নামাজ আদায় করা। ফরজ নামাজের ওয়াক্ত না হলে অজুর সুন্নত হিসেবে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা।নামাজের পর কিবলামুখী হয়ে ইহরাম পরিধান করা। ইচ্ছা করলে বাহনে (গাড়িতে) উঠে যাত্রার প্রাক্কালে ইহরাম করতে পারেন। তবে মিকাত থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার আগে ইহরাম করতে হবে। ইহরামের নিয়তে এই দোয়া পড়া যায়।উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল উমরাতা ফা-ইয়াসসিরহা লি ওয়া তাকাব্বালহা মিন্নি।
অর্থ : হে আল্লাহ, আমি ওমরাহর ইচ্ছা করছি; আপনি আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন।এরপর বলবেন, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা ওমরতান/ওমরাহ (অর্থ হে আল্লাহ, ওমরাহকারী হিসেবে আপনার দরবারে হাজির)।এরপর নবী (সা.) যেভাবে তালবিয়া পড়েছেন সেভাবে তালবিয়া পড়বেন। সেই তালবিয়া হচ্ছে, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকা লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা শারিকা লাক।’

পুরুষরা উচ্চ স্বরে তালবিয়া পড়বেন। ওমরাহর ক্ষেত্রে ইহরামের শুরু থেকে তাওয়াফ শুরু করার আগ পর্যন্ত তালবিয়া পড়ার বিধান আছে। তাওয়াফ শুরু করলে তালবিয়া পড়া ছেড়ে দেয়া যায়।ইহরাম পরিধানের পর কিছু কাজ নিষিদ্ধ। যেমন—সেলাইযুক্ত কাপড় বা জুতা ব্যবহার নিষিদ্ধ। অনুরূপ মস্তক ও মুখমণ্ডল ঢাকা। চুল কাটা বা ছিঁড়ে ফেলা। নখকাটা। ঘ্রাণযুক্ত তৈল বা আতর লাগানো। স্ত্রীর সঙ্গে সংগম করা। যৌন উত্তেজনামূলক কোনো আচরণ বা কোনো কথা বলা। শিকার করা। ঝগড়া-বিবাদ বা যুদ্ধ করা। চুল-দাড়িতে চিরুনি বা আঙুল চালনা করা, যাতে ছিঁড়ার আশঙ্কা থাকে। শরীরে সাবান লাগানো। উকুন, ছারপোকা, মশা ও মাছিসহ কোনো জীবজন্তু হত্যা করা বা মারা। যেকোনো ধরনের গুনাহের কাজ করা।

২. তাওয়াফ করা
ওমরার জন্য তাওয়াফ করা ফরজ। পবিত্র কাবাগৃহ সাতবার প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলা হয়। ওমরাহর উদ্দেশ্যে মসজিদে হারামে ডান পা দিয়ে প্রবেশ করে নির্ধারিত/বিভিন্ন দোয়া পড়া।
এরপর তাওয়াফ শুরু করার জন্য হাজরে আসওয়াদের দিকে এগিয়ে যাওয়া।ডান হাত দিয়ে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করাও চুমু খাওয়া।যদি হাজরে আসওয়াদে চুমু খেতে না পারা যায়, হাত দিয়ে স্পর্শ করবেন ও হাতে চুমু খাবেন। যদি হাত দিয়ে স্পর্শ করতে না পারেন তাহলে হাজরে আসওয়াদের দিকে মুখ করে হাত দিয়ে ইশারা করে এবং তাকবির বলা। কিন্তু হাতে চুমু না খাওয়া । তাওয়াফে পুরুষরা ইজতিবা ও রমল করবেন। নারীদের ওমরায় ইজতিবা ও রমল নেই। পুরুষ তাওয়াফকারীদের জন্য ইজতিবা ও রমল সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। আর ইজতিবা হলো -তাওয়াফের সময় পুরুষরা গায়ের চাদরকে ডান বগলের নিচে দিয়ে চাদরের উভয় মাথাকে বাম কাঁধের ওপর দিয়ে সামনে এবং পেছনে ফেলে রাখা। ডান কাঁদ খালি রাখা।রমলঃ-ফরজ তাওয়াফের সময় পুরুষগণ প্রথম তিন চক্কর বীরদর্পে দুই কাঁধ ও শরীর হেলিয়ে-দুলিয়ে ঘন ঘন পায়ে দ্রুত চলা। তাওয়াফের সময় কাবা শরিফ ও হাজরে আসওয়াদকে বাম দিকে রেখে রোকনে শামি ও রোকনে ইরাকি অতিক্রম করে  যখন রুকনে ইয়ামেনিতে (হাজরে আসওয়াদের পর তৃতীয় কর্নার) পৌঁছবেন তখন সে কর্নার চুমু ও তাকবির ছাড়া শুধু স্পর্শ করা।যদি স্পর্শ করা সম্ভব না হয় তাহলে তাওয়াফ চালিয়ে যাওয়া, ভিড় করতে নেই।এ স্থানে তালবিয়া, তাকবির তাসবিহ ইত্যাদি পড়বেন।এবং কোরআনে শেখানো এ দোয়া পড়বেন—উচ্চারণ : ‘রাব্বানা আতিনা ফিদদুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াক্বিনা আজাবান নার।’
যখনই হাজরে আসওয়াদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবেন, তখন হাজরে আসওয়াদ অভিমুখী হয়ে তাকবির বলবেন। তাওয়াফের অন্য অংশে যা কিছু খুশি জিকির, দোয়া ও কোরআন তিলাওয়াত করবেন। তাওয়াফ শেষ করার পর চাদর/কাপড় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া কারণ ইজতেবা শুধু তাওয়াফের মধ্যে করতে হয়।সাত চক্কর তাওয়াফ শেষ করার পর ডান কাঁধ ঢেকে নিয়ে মাকামে ইবরাহিমে আসবেন এবং পড়বেন: ‘ওয়াত্তাখিজু মিম মাকামি ইবরাহিমা মুসল্লা।’অতঃপর মাকামে ইবরাহিমের পেছনে দুই রাকাত নামাজ আদায় করবেন।প্রথম রাকাতে সুরা ফাতিহার পর সুরা কাফিরুন পড়বেন। দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ফাতিহার পর সুরা ইখলাস পড়বেন।
দুই রাকাত সালাত আদায় করার পর জমজমের পানি পান করবেন।মাতাফের (তাওয়াফ করার স্থান) চতুর্দিকে জমজমের গরম ও ঠাণ্ডা পানির ঝার/ড্রাম আছে। জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করা এবং পান করার সময় দোয়া—‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফি’আ, ওয়ারিজক্বাও ওয়াসি’আ, ওয়াশিফাআম মিন কুল্লি দা’ঈ।’ (হে আল্লাহ, আমাকে উপকারী জ্ঞান দান করুন! পর্যাপ্ত রিজিক দান করুন! সব রোগের শিফা দান করুন)।

৩. সাফা-মারওয়া সাঈ করাঃ-তাওয়াফের পর সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে ৭ বার সাঈ করা ওয়াজিব। সাঈ করার মাধ্যমে ওমরার কাজ সম্পন্ন হবে। সাফা পাহাড় থেকে সাঈ শুরু হবে আর মারওয়া পাহাড়ে গিয়ে সাঈ শেষ হবে।সাঈ সমাপ্ত করে আমরা নিকটবর্তী সেলুন লাইন ধরে মাথা মুণ্ডু করে হোটেলে চলে আসি। এখানে গোসল করে স্বাভাবিক কাপড় পড়ে হালাল হয়ে যাই।ওমরার হুকুমঃ হানাফি ও মালেকি মাজহাবে ওমরা করা সুন্নত। আর শাফেঈ ও হাম্বলি মাজহাবে ওমরা করা ফরজ। অর্থাৎ যার উপর হজ ফরজ তার ওপর ওমরা করাও ফরজ।