ভালো কোনো সংবাদ পেলে, কাঙ্ক্ষিত কোনো বিষয় পেলে আমরা আল্লাহতায়ালার নিকট কৃতজ্ঞতা আদায় করি। কৃতজ্ঞতা আদায় করতে বলি- আলহামদুলিল্লাহ কিংবা মাশাআল্লাহ।
পছন্দনীয় কোনো কিছুর সংবাদ দিতে গেলে হয়তো বলি, আল্লাহর রহমতে আমার এমন এমন হয়েছে।
কিন্তু কখনও কখনও আমরা এ শব্দগুলো অন্যায়ভাবেও ব্যবহার করি। কোনো বিপদের বর্ণনা দিতে গিয়ে কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো পরিস্থিতির বিবরণে আমরা হরহামেশাই এ শব্দগুলো ব্যবহার করি। যেমন, ‘আল্লাহর রহমতে আজকে এমন জ্যাম দেখলাম- যা জীবনেও দেখিনি। ’
ভালো-মন্দের মিশেলেই মানুষের জীবন। এখানে সুখ আছে, আনন্দ আছে, আবার আছে বিপদ ও কান্নাও। বিপদ কখনও বলে আসে। অর্থাৎ আগে থেকেই কিছুটা আশঙ্কা থাকে বিপদ আসার। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই বিপদ বলে আসে না।
বয়স যখন বাড়তে থাকে তখন যৌবনের শক্তি কিছুটা কমতে থাকে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন রোগ শরীরে জায়গা করে নেয়। এসব স্বাভাবিক। আশি বছরের কোনো বৃদ্ধ যখন লাঠি ভর করে হাঁটেন তখন এতে কারও অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। কিন্তু বিশ বছরের তরুণ যদি দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে স্ক্র্যাচে ভর করে পথ চলে, তখন তাতে আমরা অবাক হই, ব্যথিত হই।
পবিত্র কোরআনের ভাষায় এগুলো আমাদের জন্যে পরীক্ষা। ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করবো সামান্য ভয় ও ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফসলের কিছুটা ক্ষতি দিয়ে; আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও- যাদের ওপর কোনো বিপদ এলে বলে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন- নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর আর অবশ্যই আমরা তার কাছেই ফিরে যাবো। ’ –সূরা বাকারা: ১৫৫-১৫৬
কোরআনের শিক্ষা এখানে সুস্পষ্ট। কেউ যখন এমন কোনো পরীক্ষার মুখোমুখি হবে তখন ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে বলবে- ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। কারও মৃত্যু সংবাদ শুনে ইন্নালিল্লাহ তো আমরা পড়ে থাকি, কিন্তু হাদিসের শিক্ষা হলো- যখন তোমার জুতার ফিতা ছিড়ে যায়; তখনও তুমি ইন্নালিল্লাহ পড়ো! অর্থাৎ জুতার ফিতা ছিড়ে যাওয়াও একটি আকস্মিক বিপদ। এতে সামান্য হলেও সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। তুমি ইন্নালিল্লাহ পড়ে ধৈর্যের পরিচয় দাও; ভালো-মন্দ সবকিছুই আল্লাহর হাতে সঁপে দাও।
‘কেমন আছেন’- এর উত্তরে আমরা বলি- আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আলহামদুলিল্লাহ অর্থ সকল প্রশংসা আল্লাহর। এটা বলা আল্লাহতায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো। ভালো কোনো সংবাদেও আমরা আলহামদুলিল্লাহ বলে থাকি। মানে আমাদের তো করার কিছুই ছিলো না, আমরা এ বিষয়টির উপযুক্তও ছিলাম না। আল্লাহ দয়া করে আমাদেরকে তা দিয়েছেন। তাই তার জন্যেই সকল প্রশংসা। কোনো কিছু দেখে বা শুনে যখন মুগ্ধ হই তখন- ‘মাশাআল্লাহ’ বলি। মানে আল্লাহ যা চেয়েছেন তাই তো হয়, আমার কিংবা আমাদের চাওয়াতে কিছুই হয় না। এটাও আল্লাহতায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা। কথায় কথায় আমরা বলি, আল্লাহর রহমতে আমার এটা হয়েছে, ওটা হয়েছে ইত্যাদি।
এটাই কোরআন-হাদিসের শিক্ষা। ভালো কিছু পেলে ‘আলহামদুলিল্লাহ, মাশাআল্লাহ ও আল্লাহর রহমত’ বলে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো কিছুর মুখোমুখি হলে- ‘ইন্নালিল্লাহ’ বলে সবরের পরিচয় দেওয়া।
অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো পরিস্থিতিতে আমরা পেরেশান হই, ব্যথিত হই, কখনও কান্না পায়। তখন সেটাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা বিবেচনা করে ধৈর্য ধরতে হবে। অপ্রীতিকর কোনো বিষয়ে যেমন আমরা আনন্দিত হই না, তেমনি একে তো আমরা আল্লাহর দয়াও মনে করি না, বরং এটাকে পরীক্ষাই মনে করি। তাই যদি হয়, তাহলে তা প্রকাশের ক্ষেত্রে কেন- আলহামদুলিল্লাহ, মাশাআল্লাহ জাতীয় শব্দ? আমাদের অজান্তেই এতে কি কিছুটা উপহাস হয়ে যাচ্ছে না?
হ্যাঁ, যখন যে অবস্থায় থাকুন সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকুন- এটাই হাদিসের শিক্ষা। দুর্ঘটনায় যদি কারও একটি পা ভেঙ্গে যায় তাহলে সে এভাবে চিন্তা করতে পারে- আল্লাহ আমাকে রক্ষা করেছেন, আমার তো দু’টি পা-ই ভেঙে যেতে পারত। এভাবে চিন্তা করলে যেকোনো বিপদাক্রান্ত ব্যক্তিই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার উৎস খুঁজে পাবে।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রীতিকর কিছু দেখতেন বলতেন, সকল প্রশংসা আল্লাহর, যার অনুগ্রহে সব ভালো জিনিস পূর্ণতা পায়। আর যখন অপ্রীতিকর কিছু দেখতেন তখন তার মুখে উচ্চারিত হতো- ‘আলহামদুলিল্লাহি আলা কুল্লি হাল। ’ -সুনানে ইবনে মাজা
এসব বিষয় সামনে রেখে যে কোনো বিপদে, কঠিন পরিস্থিতিতে, সঙ্কটে ও অসুস্থতায় আমাদেরকে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। চরম বিপদের সময়ও তাই আমরা বলি, আল্লাহ যেমন রেখেছেন ভালোই রেখেছেন। এটা আমাদের বলতেই হবে। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে- ‘ভালো নেই’ জাতীয় কোনো শব্দ আমাদের অভিধানে থাকতে পারে না।