বছর ঘুরে আবার আসছে পবিত্র ঈদুল আজহা। প্রতি বছর ঈদুল আজহা এবং কোরবানি আমাদের যে শিক্ষা দিয়ে যায়, আমরা তা সঠিকভাবে প্রতিপালন করতে পারলে সারাটি বছর ইসলামের ওপর অটল-অবিচল থাকা সহজ হয়ে যাবে।
আমরা যে কোরবানি করে থাকি, তা মুসলিম মিল্লাতের পিতা আল্লাহর নবী হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক তাঁর শিশুপুত্র নবী হজরত ইসমাইলকে (আ.) কোরবানি করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রবর্তিত হয়েছে। এ কোরবানির উদ্দেশ্য নিছক পশু জবেহ আর গোশত খাওয়া নয়, বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে- আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রিয়তম বস্তুকে আল্লাহর পথে সমর্পণ করা। আল্লাহ তায়ালার যে কোনো হুকুম যে কোনো সময় মাথা পেতে নেয়া হচ্ছে কোরবানির শিক্ষা।
হজরত ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) এ দৃষ্টান্তই রেখে গেছেন। তাই আল্লাহ তায়ালার যে কোনো আদেশ-নিষেধ আমাদের খুশি মনে মেনে নিতে হবে। এ ব্যাপারে কোনোরকম আপত্তি তোলার কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ তায়ালা মহাজ্ঞানী। তাঁর জ্ঞানের কাছে আমাদের জ্ঞান বিশাল বালুকণাময় প্রান্তরে ক্ষুদ্র এক বালুকণার মতোও নয়। তাই ইসলামের কোনো বিধান আমাদের সীমিত জ্ঞানে বুঝে না আসলেও তা অবনতচিত্তে মেনে নিতে হবে। মহান আল্লাহ কোরবানি ও জীবনদানের প্রেরণা ও চেতনা সারাটি জীবনে জাগ্রত রাখার জন্য রাসুলকে (সা.) নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘বলুন হে মুহাম্মদ! আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সব কিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য। তাঁর কোনো শরিক নেই। আমাকে তাঁরই নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আমি সবার আগে তাঁর অনুগত ও নির্দেশ পালনকারী। (সূরা আনআম, আয়াত-১৬২)
কোরবানি শব্দের অর্থ ত্যাগ স্বীকার করা। আত্মত্যাগের উৎকৃষ্ট মাধ্যম হচ্ছে কোরবানি। হজরত সাহাবায়ে কেরাম (রা.) প্রিয় নবীজীর (সা.) রেখে যাওয়া ইসলামকে বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য নিজেদের মাতৃভূমি ও প্রিয়জনদের মায়া ত্যাগ করে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তাই তাঁদের কবর পৃথিবীর এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তাঁদের এই আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ আমাদের কাছে ইসলামের আওয়াজ পৌঁছেছে। যার কারণে আমরা মুসলমান। এভাবে তাঁরা ইসলামের জন্য কোরবানি করেছিলেন।
প্রিয় নবীজীর রেখে যাওয়া এই ইসলামের নাম-নিশানা পৃথিবী থেকে মুছে ফেলার জন্য ইসলামবিদ্বেষী অপশক্তিগুলো মাঝে-মধ্যেই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তারা ইসলামকে নির্মূল করে মুসলমানদের ওপর তাদের মনগড়া নিয়মনীতি চাপিয়ে দিতে চায়। তাদের হাত থেকে নবীজীর (সা.) রেখে যাওয়া ইসলামকে রক্ষা করার জন্য আমাদের আত্মত্যাগে বলিয়ান হতে হবে। সকল পরিস্থিতির মোকাবেলা করে বিশ্বের বুকে ইসলামকে বিজয়ী রাখতে হবে। অতএব, আমাদের আল্লাহর নবী হজরত ইবরাহিম এবং ইসমাইল (আ.) এর চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির পথে নিজেদেরকে পরিচালিত করতে হবে।
কোরবানি যাদের ওপর ওয়াজিব :
১. জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ফজর থেকে ১২ জিলহজের সন্ধ্যা পর্যন্ত অর্থাৎ কোরবানির দিনগুলোতে যাদের কাছে নিত্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত শরয়ী নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকবে তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব। নেসাবের পরিমাণ হলো, সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা বা এ পরিমাণ অর্থের মালিক হওয়া। কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে সম্পদ এক বছর পর্যন্ত নেসাবের মালিকের কাছে থাকা জরুরি নয়। বর্তমান বিশ্ব বাজারে রুপার মূল্য স্বর্ণের মূল্যের তুলনায় কম হওয়ায় নেসাবের ক্ষেত্রে রুপার মূল্যই গণ্য হবে। প্রত্যেক দেশে সেখানকার বাজার মূল্য ধর্তব্য হবে।
২. মুসাফিরের ওপর (সফরে থাকলে) কোরবানি করা ওয়াজিব নয়। তবে কারো ওপর কোরবানি ওয়াজিব না হলেও কোরবানি করলে নফল কোরবানির সওয়াব পাওয়া যাবে।
৩. কোরবানি শুধু নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজিব হয়। সন্তানাদি, মাতা-পিতা ও স্ত্রীর পক্ষ থেকে ওয়াজিব হয় না, তবে তাদের পক্ষ থেকে করলে তা নফল কোরবানি হবে।
৪. যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয় সে কোরবানির নিয়তে পশু কিনলে সেই পশু কোরবানি করা তার ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়।
৫. কোনো উদ্দেশ্যে কোরবানির মান্নত করলে সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে গরিব হোক বা ধনী হোক তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব।
৬. যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব সে কোরবানির দিনগুলোতে কোরবানি না করলে কোরবানির দিনগুলো চলে যাওয়ার পর একটা বকরির মূল্য সদকা করা ওয়াজিব।