আন্দোলন নিয়ে ‘আলোচনায়’ বিএনপি

তাকিয়ে আছে ‘বিদেশি চাপে’র দিকে

বিশেষ প্রতিবেদক
  ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:৪৯

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নিজেদের দাবি বাস্তবায়নে সামর্থ্যের মধ্যে সব রকমের আন্দোলন করেছে বিএনপি। এর মধ্যে ছিল বিক্ষোভ, গণমিছিল, অবস্থান, মানববন্ধন, সমাবেশ, হরতাল, অবরোধ, এমনকি ‘অসহযোগ’ আন্দোলনও।
তাদের এসব কর্মসূচিতে ‘যুগপৎ’ভাবে পালন করেছে জামায়াতসহ কিছু বিরোধী রাজনৈতিক দলও। কিন্তু কোনোভাবেই টলানো যায়নি সরকারকে। রাজবন্দিদের মুক্তি বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন—কোনো দাবিই আদায় করতে পারেনি বিএনপি।
বিদেশি কিছু চাপ সত্ত্বেও সরকার গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচন করে ফেলেছে। এমনকি তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ ওই নির্বাচনের পর সরকার মন্ত্রিসভাও গঠন করে ফেলেছে। সরকারের এ ‘বিজয়ের’ পর বিএনপি কী করবে বা করতে চায়, তা নিয়েই এখন কৌতূহল রাজনৈতিক অঙ্গনে। খোদ বিএনপির নেতা-কর্মীরাও এ নিয়ে ভীষণ আগ্রহী। দলটির পরবর্তী রাজনৈতিক ‘কৌশল’ কী হবে, তা নিয়েই আলোচনা চলছে সর্বত্র।
প্রায় ৪২ শতাংশ ভোটগ্রহণের নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যের শপথের পর সরকার মন্ত্রিসভা গঠন করে ফেললেও বিএনপির নেতারা মনে করছেন, ভোট পড়ার হার সরকারের দাবির চেয়ে অনেক কম। যেটা বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জনগণ নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এটাই বিএনপির আন্দোলনের প্রথম সফলতা। এই সফলতার পথ ধরে বিএনপি তাদের পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করবে। এক্ষেত্রে ‘বিদেশি চাপের’ দিকেও নজর থাকবে তাদের।
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলটির নীতি-নির্ধারকরা এখন পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করছেন। একাধিক নেতার মতে, সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের চাপ বাড়ানোর পাশাপাশি দেশে গণতন্ত্রের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দেবে বিএনপি। এছাড়া সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন চালানোরও পরিকল্পনা করছে দলটি।
যদিও বিএনপির পরবর্তী কর্মসূচি কী হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। দলের নীতি-নির্ধারকরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। সেটা শনিবার (১৩ জানুয়ারি) বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সংবাদ সম্মেলনেই উঠে এসেছে। নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এক দফা দাবিতে সরকার পতনের পরবর্তী আন্দোলনের ধারা ঠিক করছে বিএনপি। সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে কর্মসূচি নির্ধারণ করবে তারা।
যদিও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ অনেক শীর্ষ নেতা কারাগারে। রিজভীর ভাষ্যে, তাদের নেতারা পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে প্রতিদিন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিএনপির নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতা বলছেন, নির্বাচন বর্জনের বিষয়ে জনগণকে তারা সফলভাবে সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন। এ ধারাবাহিকতায় বিএনপির পরবর্তী লক্ষ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে এটা প্রমাণ করা যে, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। এই লক্ষ্যে বিএনপি সরকারের নির্বাচনের নানা কর্মকাণ্ডের ২৫০টি ঘটনার প্রমাণসহ একটি বই বের করেছে। একইসঙ্গে ভিডিও ক্লিপও রয়েছে। এ ধরনের আরেকটি ভলিয়ম বিএনপি অল্প কিছুদিনের মধ্যে জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে চায়।
বিএনপির এই উদ্যোগ সাধুবাদ পাচ্ছে অন্য বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও। তারা মনে করেন, বিএনপির এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বাংলানিউজকে বলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আগের মত নেই। আগে রাজনীতি এমন ছিল যে, জনগণ যদি কোনো বিষয়ের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাতো বা আন্দোলন করতো তাহলে সেখানে সরকারের ইচ্ছা না থাকলেও বিষয়টা আমলে নিতো। তবে বর্তমান সরকার এমন নয়। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা জনগণের দাবি বা আন্দোলন কোনো কিছুকেই পাত্তা দেয় না। তাই এমন সরকারের কাছে কোনো দাবি জানিয়ে বা আন্দোলন করে লাভ নেই।
বিদেশি চাপ বা নিষেধাজ্ঞা আসলে সরকার বেকায়দায় পড়বে এমনটা জানিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, সেখানে আন্তর্জাতিক মহল বা গণতান্ত্রিক দেশগুলো যদি চাপ সৃষ্টি করে, তাহলে সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে বাধ্য হতে পারে। কারণ সরকারের নেতারা দেশ থেকে যে পরিমাণ টাকা পাচার করেছেন তা দেশের বাইরে আছে। পাশাপাশি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক বৈদেশিক সুবিধা পায়, সেখানে বিদেশি চাপ বা নিষেধাজ্ঞা এলে সরকার বেকায়দায় পড়বে।
তবে আন্তর্জাতিক মহল বিএনপির কথায় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে কি না? এই প্রশ্নের উত্তর এখনই দেওয়া কঠিন বলে স্বীকার করেন ওই নেতা।
যদিও বিদেশিদের দিকে বিএনপির তাকিয়ে থাকা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও দলটির সমালোচনা করেছেন। তিনি শনিবার (১৩ জানুয়ারি) গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে নতুন মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে শ্রদ্ধা নিবেদন সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচন বর্জনকারীরা এখনো কিছু হটেনি। আজকে তারা নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। এ সরকার যেন থাকতে না পারে। তারা আশা করছে, কম্বোডিয়ার মতো নিষেধাজ্ঞা দেশে আসবে। কিন্তু (প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনা ভিসা বিধি নিষেধের কোনো পরোয়া করেন না। ’
দীর্ঘ দিন তালাবদ্ধ থাকা বিএনপির দলীয় কার্যালয় খোলার পর গেল বৃহস্পতিবার (১১ জানুয়ারি) নির্বাচন নিয়ে বিএনপির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানান দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান। সেদিন তিনি বলেন, ‘সরকার একদলীয় বাকশালি কায়দায় শাসন ব্যবস্থা পরিচালনায় বিশ্বাস করে। তাই নির্বাচনের পর বিএনপির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশ, জনগণ এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে এটা প্রমাণ করা যে, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। ’