তালেবানের নিপীড়নের কথা বলতে শুরু করেছেন আফগান নারীরা

উদিসা ইসলাম
  ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ২৩:০৩

আফগান নারীদের ওপর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অন্যায়-অত্যাচার নিয়ে এতদিন খবর পাওয়া যেত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এখন সরাসরি নিজেদের খবর সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরার প্ল্যাটফর্ম পেয়েছেন আফগান নারীরা। প্রবাসী আফগান নারীরা মিলে গড়ে তুলেছেন ‘জান টাইমস’ নামক একটি অনলাইন সাময়িকী। যেখানে শাসকগোষ্ঠী তালেবান কর্তৃক বিভিন্ন নির্যাতনের কথা নারীরা বলছেন অকপটে।
সাময়িকীতে জাহরা নাদের ও ফ্রেস্তা গনির লেখায় জানা গেছে মুরসালের জীবনের কথা। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বিকাল ৪টার পরে মাস্ক দিয়ে মুখ ঢেকে দীর্ঘ কালো হিজাব পরে কর্মস্থল থেকে বের হয়েছিলেন। তার জানা ছিল জনসমক্ষে যেতে হলে তালেবানের আদেশ মেনে হিজাব পরতে হবে। ২০২২ সালে মে মাসে কার্যকর হওয়া এই আদেশটিতে বলা হয়েছিল সব নারীকে জনসম্মুখে তাদের ‘মুখ’ ঢেকে রাখতে এবং এটা না করলে তাদের পুরুষ আত্মীয়দের কারাগারে নেওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
কানাডায় বসবাসরত আফগান নারী জাহরা নাদের এই সাময়িকীটি প্রকাশ করেছেন কানাডায় বসবাসরত আফগান নারী জাহরা নাদের এই সাময়িকীটি প্রকাশ করেছেন সেদিন সন্ধ্যায় মুরসাল বাড়ি যাওয়ার সময় পেছন থেকে কেউ একজন তার হাত ধরেছিল। তিনি লেখককে বলেছেন, “যখন আমি পিছনে ফিরে তাকালাম, কালো রঙের পোশাকে মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ঢেকে থাকা এক নারী আমাকে একটি গাড়ির দিকে টেনে নিয়ে গেলেন। আমি চিৎকার করে বললাম, ‘আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’ তারপর বেশ কয়েকজন তালেবান সেনা এসে আমাকে ঘুষি ও লাথি মারতে শুরু করে। তাদের গাড়িতে আমাকে জোর করে তোলার আগ পর্যন্ত মারধর চলতে থাকে। গাড়িতে উঠে আমি আরেকজন হাজারা নারীকে দেখতে পাই।” জান টাইমস-এর পক্ষ থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অডিও বার্তায় এসব কথা জানান।
মুরসাল নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তালেবানরা আমাদের পুলিশ কাস্টডিতে নেয় এবং সেখানে তারা আমাদের চুলের মুঠি ধরে, পায়ে তার দিয়ে মারধর করে এবং আমাদের মাথা পানিতে চুবিয়ে রাখে। আমরা কীভাবে নামাজ পড়ি তা সম্পর্কে তারা জিজ্ঞাসা করেছিল এবং বলেছিল, ‘আপনি হাজারা, আপনি মুসলিম নন।’ আমি কখনোই ভুলবো না যে আমি একজন হাজারা এবং একজন নারী হওয়ার অপরাধে গ্রেফতার হয়েছি।
উল্লেখ্য, হাজারা আফগানিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম জাতিগত গোষ্ঠী। এছাড়া প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানেও তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত।
মুরসাল হলেন কাবুলের তিন হাজারা নারীর একজন, যারা তালেবান হেফাজতে আটক ও ভয়াবহ নির্যাতনের ভেতর দিয়ে গেছেন এবং ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে জান টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা বলছেন, হাজারা নারী হিসেবে তাদের জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তালেবানরা তাদের বিশেষভাবে টার্গেট করেছে।
আরেক নারী মার্জিয়াকে নিয়ে করা প্রতিবেদনে তার অভিজ্ঞতার কথা লেখা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার জামাকাপড় লম্বা ছিল এবং আমার একটি মুখোশ ছিল, যাতে আমার মুখ ঢেকে ছিল, কিন্তু ২ জানুয়ারি সন্ধ্যার আগে আমি যখন মা দিবসের জন্য কেনাকাটা করছিলাম, তখন তালেবানরা আমাকে, আমার বন্ধুকে এবং আরও আটজন নারীকে ঘিরে ফেলে। আমি কারাগারে তিন রাত কাটিয়েছি, সেখানে তারা আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে, নির্যাতন করে।’
মানসিক ট্রমা নিয়েও কথা বলতে দেখা গেছে অনেককে। আফগানিস্তানের রক্ষণশীল সমাজে, নারীদের গ্রেফতার তাদের পরিবারের জন্য ‘লজ্জা’ ও ‘অসম্মানজনক’ এবং এই পরিস্থিতি নারীদের সমাজ ও পরিবার থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে এবং তাদের সামাজিক কলঙ্ক এবং মানসিক অসুস্থতার ঝুঁকিতে রাখে। বন্দিজীবন ও নির্যাতনের অভিজ্ঞতা নারীদের ভেতরে ও বাইরে ভয়াবহ ট্রমার মধ্যে রেখেছিল।
পাইমান আরমান লিখেছেন কীভাবে তালেবানের বৈষম্যমূলক ও নারীবিরোধী অবস্থান দিন দিন দৃশ্যমান হচ্ছে। ১ জানুয়ারি থেকে তারা নির্বিচারে পাবলিক প্লেসে নারীদের আটকে রেখে মারধর করছে। অভিযোগ, অপর নারীরা তাদের দেখে সঠিকভাবে হিজাব না পরতে উৎসাহিত হচ্ছে।
লালা শামস-এর লেখায় উঠে এসেছে আরেক নারীর স্বর। তিনি শোনান কীভাবে তাদের এক মিনিটের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তার বাড়িওয়ালা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, তোমাদের জন্য আমি কোনও সমস্যায় পড়তে চাই না। এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও। আমি আমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে। দৃশ্যত বিচলিত এবং নার্ভাস হয়ে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমাদের চলে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি। আমরা না গেলে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে’।
কানাডায় বসবাসরত আফগান নারী জাহরা নাদের এই সাময়িকীটি প্রকাশ করেছেন। আফগানিস্তানে বসবাসরত নারী ছাড়াও এতে কাজ করছেন বিশ্বের অন্যান্য দেশে থাকা আফগান নারীরা।
এই স্বর শুনতে পাওয়া খুব জরুরি উল্লেখ করে আমরাই পারি জোটের সমন্বয়ক জিনাত আরা হক বলেন, তালেবানরা নারীদের দমন-পীড়ন-নির্যাতন করে এসব আমরা বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমে পেয়েছি। কিন্তু এই যে নিজেদের কথা তারা অকপটে বলছেন, এটি আন্তর্জাতিকভাবে তাদের অবস্থান আরও স্পষ্ট করবে। যারা এখনও আফগানিস্তানে আছেন তাদের হয়ে প্রবাসী নারীদের এই উদ্যোগ ভেতরের আরও অজানা কথা সামনে নিয়ে আসবে। নারীরা অধিকার নিশ্চিতে আরও সরব হবেন, সেই প্রত্যাশা থাকবে।.

সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন