মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট দেশটির নারীদের গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু রাজ্যে গর্ভপাত করানোর ক্লিনিক বন্ধ হওয়া শুরু হয়েছে। প্রায় ৫০ বছরের পুরনো রো বনাম ওয়েড মামলার রায় যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতে উল্টে যাওয়ায় দেশটির প্রায় অর্ধেক রাজ্যই শিগগিরই গর্ভপাতের ওপর বিধিনিষেধ বা নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
১৩ টি রাজ্য আগে থেকেই গর্ভপাতকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করতে আইন ও সংবিধান সংশোধনের মতো পদক্ষেপ নেয়। সুপ্রিম কোর্টের শুক্রবারের আদেশের ফলে সেগুলো আপনা থেকেই কার্যকর হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রিপাবলিকান অধ্যুষিত সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে ‘বেদনাদায়ক ভুল’ অ্যাখ্যা দিয়েছেন বলেও জানিয়েছে বিবিসি।
সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পর যুক্তরাষ্ট্রের বেশকিছু শহরে গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে। অ্যারিজোনার ফিনিক্সে বিক্ষোভকারীরা রাজ্যের ক্যাপিটল ভবনের দরজা-জানালায় ধাক্কাধাক্কি শুরুর পর পুলিশকে কাঁদুনে গ্যাস ছুড়তে হয়েছে। লস এঞ্জেলেসে বিক্ষোভকারীরা কিছু সময়ের জন্য একটি মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল। শনিবারও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে বিক্ষোভ হওয়ার কথা।
আরকানসোর লিটল রকে একটি গর্ভপাত ক্লিনিক সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনলাইনে আসার পরপরই রোগীরা যেখানে থাকে সেখানকার দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়। সেখানকার কর্মীরা ফোন করে বিভিন্ন নারীদেরকে তাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল হয়েছে বলেও জানায়।
“দুঃসংবাদের জন্য আমরা যতই প্রস্তুত থাকি না কেন, যখন সত্যিই খবরটা আসে তখন তা খুব জোরেই আঘাত করে। রোগীদের ফোন দিয়ে তাদেরকে রো বনাম ওয়েড মামলার রায় বদলে যাওয়ার কথা বলা সত্যিই হৃদয়বিদারক,” বিবিসিকে এমনটাই বলেছেন নার্স অ্যাশলি হান্ট। ক্লিনিকটির বাইরে গর্ভপাতবিরোধীরা তখন উল্লাসে মত্ত।
সুপ্রিম কোর্টের আদেশ তখন পর্যন্ত না জানা যারা ক্লিনিকটির বাইরে গাড়ি পার্ক করছিল তাদের উদ্দেশ্যে এক গর্ভপাতবিরোধী বিক্ষোভকারীকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়,“আমার পরামর্শ হচ্ছে আপনারা গাড়ি ঘুরিয়ে নিন এবং এই পাপের জায়গা, অসমতার, মন্দ জায়গা থেকে চলে যান।”
লুইজিয়ানায় যে তিনটি প্রতিষ্ঠানে গর্ভপাতের সেবা মেলে তার একটি নিউ অরলিন্সের উইমেনস হেলথ কেয়ার সেন্টার সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পরপরই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে; কর্মীদেরও তৎক্ষণাৎ বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষের অনেকেই বলছেন, সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পর ধনী নারীদের পক্ষে এখন যে যে রাজ্যে গর্ভপাতের সুযোগ থাকবে সেখানে চলে যাওয়া সম্ভব হলেও দরিদ্ররা পড়বেন বিপাকে। তাদেরকে তখন অবৈধ পন্থায় গর্ভপাতের দিকে ঝুঁকতে হবে। সব মিলিয়ে দেশটিতে প্রজননক্ষম প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ নারী গর্ভপাতের অধিকার হারাতে পারে বলে হিসাব দেওয়া হয়েছে গর্ভপাত নিয়ে কাজ করা স্বাস্থ্যসেবা সংগঠন ‘প্ল্যানড প্যারেন্টহুড’ এর গবেষণায়।
সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পর কেন্টাকি, লুইজিয়ানা, আরকানসো, সাউথ ডাকোটা, মিসৌরি, ওকলাহোমা ও অ্যালাবামায় গর্ভপাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা বা বিধিনিষেধ তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়ে গেছে। মিসিসিপি ও নর্থ ডাকোটায় এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে তাদের অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুমোদনের পর। উয়োমিংয়ে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে ৫দিনের ভেতর; উটাহ-র নিষেধাজ্ঞা তাদের আইনপরিষদে স্বীকৃত হতে হবে। আইডাহো, টেনেসি ও টেক্সাসে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে ৩০ দিনের মধ্যে।
গর্ভপাত ইস্যুটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি স্পষ্ট হলেও সম্প্রতি পিউ-র এক জরিপে ৬১ শতাংশ আমেরিকান ওই অধিকারের পক্ষে থাকার কথা জানিয়েছিলেন, বিরোধী পাওয়া গেছে ৩৭ শতাংশকে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ নারীদের জীবন ও স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
যেসব রাজ্যে গর্ভপাত বৈধ থাকবে, অন্য রাজ্যগুলো থেকে সেখানে নারীদের যেতে যেন বাধার মুখে পড়তে না হয় তা নিশ্চিতে এবং গর্ভনিরোধক ও ১০ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভধারণ বন্ধে বিভিন্ন ওষুধ সহজে পেতে পারে সেজন্য বিভিন্ন রাজ্য কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজ করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলের রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া, ওয়াশিংটন ও ওরেগনের গভর্নরার অন্য রাজ্য থেকে গর্ভপাত করাতে আসা রোগীদের সুরক্ষা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। পেনসিলভানিয়া, মিশিগান ও উইসকনসিনের মতো কিছু কিছু রাজ্যের বাসিন্দাদের মধ্যে গর্ভপাতের পক্ষে-বিপক্ষে সমর্থন প্রায় সমান সমান। এসব রাজ্যে প্রত্যেকটি নির্বাচনের ফলের উপর সেখানে গর্ভপাত বৈধ থাকবে কিনা তা নির্ভর করতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টের শুক্রবারের আদেশ যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে অনেকগুলো আইনি লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটাবে বলেই মনে করা হচ্ছে। এই আদেশ দেশটির নাগরিকদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি আরও প্রকট করবে। দেশটির সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট, রো বনাম ওয়েড মামলার আগের রায়ের দীর্ঘদিনের সমালোচক মাইক পেন্স যুক্তরাষ্ট্রের সবগুলো রাজ্যে যতদিন পর্যন্ত আইনিভাবে ‘জীবনের পবিত্রতা’ সুরক্ষিত হবে না, ততদিন লড়াই চালিয়ে যেতে গর্ভপাতবিরোধীদের পরামর্শ দিয়েছেন।