ট্রাম্প-কমলার জয় নির্ধারণ করবে ১০ কারণ 

ডেস্ক রিপোর্ট
  ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:২৯

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের জনমত জরিপগুলোতে দুই প্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান যৎসামান্য। তাই ধারণা করা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প বা কমলা হ্যারিস— যেই জিতুক না কেন, খুব অল্প ভোটের হেরফের হবে। দুজনের মধ্যে যে কোনো একজন দুই বা তিন পয়েন্ট এগিয়ে থাকতে পারেন। ঠিক কী কী কারণে হ্যারিস বা ট্রাম্প জিততে পারেন এমন ১০ টি কারণ বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি। নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হলে তিনি হবেন ১৩০ বছরের মধ্যে প্রথম সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি আগে একবার পরাজিত হয়েছেন। এমন ইতিহাস সৃষ্টির সম্ভাবনা দিয়ে ট্রাম্পের জয়ের পাঁচটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে।
১. তিনি ক্ষমতায় নেই
এবারের ভোটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু অর্থনীতি। যেখানে দেখানো হচ্ছে, বেকারত্ব কম এবং স্টক মার্কেট ফুলে ফেঁপে উঠছে, সেখানে বেশির ভাগ আমেরিকান বলেছেন, তাঁরা প্রতিদিন উচ্চমূল্যের সঙ্গে লড়াই করছেন। করোনাভাইরাস মহামারি পরবর্তী সময়ে মুদ্রাস্ফীতি সত্তরের দশকের পর থেকে এমন উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় এটাই ছিল ট্রাম্পের প্রধান ‘ট্রাম্প কার্ড’। মুদ্রাস্ফীতিই ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করার সুযোগ দিয়েছে, ‘আপনি কি চার বছর আগের চেয়ে এখন ভালো আছেন?’
২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে ভোটাররা বেশ কয়েকবার ক্ষমতায় থাকা দলকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে করোনা-পরবর্তী জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে। মার্কিন ভোটাররাও পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে। মাত্র এক-চতুর্থাংশ আমেরিকান বলেছেন, তাঁরা দেশটি যে দিকে যাচ্ছে তাতে সন্তুষ্ট। কমলা হ্যারিস তথাকথিত পরিবর্তনের প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে অজনপ্রিয় জো বাইডেনের কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে তিনি লড়াই করছেন।
২. দুঃসময়েও ট্রাম্পের অবিচল ভাবমূর্তি
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ইউএস ক্যাপিটলে দাঙ্গা, একের পর এক অভিযোগ ও ফৌজদারি অপরাধে নজিরবিহীনভাবে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও ট্রাম্পের সমর্থন সারা বছর ৪০ শতাংশ বা তারও বেশি স্থিতিশীল থেকেছে। ডেমোক্র্যাট ও ‘নেভার-ট্রাম্প’ শিবিরের আন্দোলনকারীরা বলছেন, তিনি হোয়াইট হাউসের জন্য অযোগ্য। আর বেশির ভাগ রিপাবলিকানই ট্রাম্পের সঙ্গে একমত যে, তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। দুই পক্ষেরই এই ধারণা এত বদ্ধমূল যে, ট্রাম্পের এখন দরকার সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের সেই অংশের যথেষ্ট সমর্থন পাওয়া যাদের তাঁর সম্পর্কে এমন কোনো বদ্ধমূল ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গি নেই।
৩. অবৈধ অভিবাসন ইস্যু
অর্থনৈতিক অবস্থার বাইরেও আবেগ বা দুর্বলতা থেকেও প্রায় ক্ষেত্রে নির্বাচনের ফল নির্ধারণ করে দেন ভোটাররা। ডেমোক্র্যাটদের প্রত্যাশা, অভিবাসন ইস্যু হয়তো আর কাজে দেবে না। আর ট্রাম্প বাজি ধরে বলছেন, অভিবাসন সমস্যার সমাধানের জন্যই তাঁকে আবার ক্ষমতায় আসকে হবে। বাইডেনের শাসনামলে সীমান্তে বিনা-বিচারে হত্যার সংখ্যা রেকর্ড স্তরে পৌঁছেছে। সীমান্ত থেকে দূরের রাজ্যগুলোতে অভিবাসনের সংখ্যাও প্রভাব ফেলেছে। এর প্রেক্ষাপটে নির্বাচনী জরিপগুলোতে দেখা যাচ্ছে, ভোটাররা অভিবাসনের বিষয়ে ট্রাম্পের ওপর বেশি আস্থা রাখছেন। ল্যাটিনোদের মধ্যেও ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা আগেরবারের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
৪. কৃষ্ণাঙ্গ ও হিসপানিক পুরুষদের সমর্থন
ডেমোক্র্যাটরা দীর্ঘদিন ধরেই হিসপানিক ও কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের বেশি সমর্থন পেয়ে এসেছে। তবে এবার হাওয়া বদলেছে। শেষ সময়ের পরিচালিত জরিপগুলোতে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প হিসপানিক পুরুষ এবং কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের সমর্থন বেশি পাচ্ছেন। রয়টার্স/ইপসোস পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, আগের চেয়ে অনেক বেশি হিসপানিক পুরুষদের সমর্থন পাচ্ছেন ট্রাম্প। নিউ জার্সির হিসপ্যানিক এক ভোটার বলেছেন, তিনি ব্যবসায়ী হিসাবে ট্রাম্পের পেশাকে শ্রদ্ধা করেন এবং তাঁকেই ভোট দেবেন বলে স্থির করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে হিসপ্যানিক ভোটারের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ১৯৭০-এর দশক থেকেই হিসপ্যানিক ভোটাররা বেশির ভাগ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের অনেক বেশি সমর্থন দিয়ে এসেছে। অথচ এ বছরের নির্বাচনে তাদেরই উল্লেখযোগ্য সমর্থন পেয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প।
৫. বিশ্বে শান্তির জন্য ট্রাম্পের ওপর আস্থা
ট্রাম্পের সমালোচকদের কথায়, তিনি কর্তৃত্ববাদী নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে আমেরিকার জোটকে দুর্বল করছেন। তবে সাবেক এই প্রেসিডেন্ট নীতি-নির্ধারণে চমক দেখানোর বৈশিষ্ট্যকে নিজের শক্তি মনে করেন। এবারের নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প এও উল্লেখ করেছেন, তিনি হোয়াইট হাউসে থাকাকালে কোনো বড় যুদ্ধ শুরু হয়নি। ইউক্রেন ও ইসরায়েলের যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাঠানোয় অনেক আমেরিকান ক্ষুব্ধ ও বাইডেনের অধীনে আমেরিকা দুর্বল বলে মনে করেন। বেশির ভাগ ভোটার, বিশেষ করে পুরুষেরা হ্যারিসের চেয়ে ট্রাম্পকেই শক্তিশালী নেতা হিসেবে দেখেন।
এই নির্বাচনে কমলা হ্যারিস জিতলে তিনি হবেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী ও ভারতীয় আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্পের চেয়ে নানা যোগ্যতায় এগিয়ে এই ডেমোক্রেট। তাঁর জয়ের জন্য যেসব কারণ উল্লেখ করেছে বিবিসি:
১. তিনি ট্রাম্প নন
ট্রাম্প বিভিন্ন দিক থেকে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও তিনি আমেরিকার রাজনীতিতে মেরুকরণকারী ব্যক্তি হিসাবে রয়ে গেছেন। ২০২০ সালে তিনি রিপাবলিকান প্রার্থীর পক্ষে রেকর্ড সংখ্যক ভোট জিতেছিলেন। কিন্তু পরাজিত হয়েছিলেন কারণ আরও ৭০ লাখ আমেরিকান বাইডেনকে সমর্থন করেছিলেন।
এবার হ্যারিস ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। তিনি তাঁকে ‘ফ্যাসিবাদী’ ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে অভিহিত করেছেন। ট্রাম্পের নাটকীয় কীর্তিকলাপ ও সংঘাতের পথ থেকে সরে তিনি ভিন্ন পথে চলার অঙ্গীকার করেছেন। জুলাইয়ে রয়টার্স/ইপসোসের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজন মার্কিনির মধ্যে চারজন মনে করেন দেশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। কমলা হ্যারিস আশা করছেন, স্থিতিশীলতা ফেরাতে ভোটাররা, বিশেষ করে মধ্যপন্থী রিপাবলিকান ও স্বতন্ত্ররা তাঁকে সম্ভাবনাময় একজন প্রার্থী হিসেবে দেখবে।
২. তিনি বাইডেনও নন
মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে পৌঢ় বাইডেন ট্রাম্পের কাছে ধরাশায়ী হলে ডেমোক্র্যাটরা এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতার মাঠ থেকে প্রায় ছিটকে পড়েছিল। এমন সময় ডেমোক্রেটদের কর্ণধার হন কমলা। তিনি আসার পর রিপাবলিকানরা মনে করেছিলেন, বাইডেনের অজনপ্রিয় নীতিই আওড়াবেন কমলা। তবে কমলা সেই ভুল ভেঙে দিয়েছেন নির্বাচনী প্রচারে। ট্রাম্পকে পরাজিত করতে এককাট্টা হয়ে দলটি দ্রুত কমলাকে নিয়ে প্রচার চালিয়েছে ও বেশ সাঁড়া ফেলেছে। বাইডেনের বয়স নিয়ে বিতর্ক ছিল, যেটা কমলার নেই। এখন নির্বাচনী মাঠ উল্টে গেছে। এ দৌড়ে এখন ট্রাম্পই সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি।
৩. তিনি নারী অধিকারের চ্যাম্পিয়ন
যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট রো ভি ওয়েড ও গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করার পর এটিই প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। গর্ভপাতের অধিকার রক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন ভোটাররা জোরালোভাবে কমলাকে সমর্থন করছেন। অতীতের নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, বিশেষত ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচন— মার্কিন নির্বাচনে গর্ভপাত অন্যতম প্রধান ইস্যু ও ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারে। এবার দোদুল্যমান রাজ্য অ্যারিজোনাসহ ১০টি রাজ্যে ভোটারদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে গর্ভপাতের অধিকার পুনর্বহালের বিষয়ে। এতে বেশির ভাগ ভোটারই নারীর গর্ভাপাতের পক্ষে মত দিয়েছেন। ফলে কমলা এসব ভোটার নিজের ব্যালটে পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া নির্বাচিত হলে তিনি হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। ফলেস তিনি নারী ভোটারদেরও টানবেন নিজের ব্যালটে।
৪. তার ভোটার উপস্থিতি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা
কমলা হ্যারিসকে বেশি ভোট দেবেন তরুণ কলেজে পড়ুয়ারা ও বয়স্ক ব্যক্তিরা। নিউইয়র্ক টাইমস/সিয়েনার জরিপে দেখা গেছে, ২০২০ সালে যারা নিবন্ধিত ছিলেন কিন্তু ভোট দেননি তাদের মধ্যে ট্রাম্প বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। এবার তারা হাজির হবেন কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
৫. নির্বাচনের জন্য বিপুল অর্থ সংগ্রহ ও ব্যয়

এটা কোনো গোপন বিষয় নয় যে, আমেরিকার নির্বাচন ব্যয়বহুল ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যয়বহুল হওয়ার পথে রয়েছে। এবার খরচ করার ক্ষেত্রে শীর্ষে কমলা।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ অনুসারে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে পুরো সময়কালে ট্রাম্প যতটা তহবিল সংগ্রহ করতে পেরেছেন হ্যারিস জুলাইয়ে প্রার্থী হওয়ার পর থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি তহবিল সংগ্রহ করতে পেরেছেন। একইভাবে নির্বাচনী প্রচার এবং বিজ্ঞাপনে ট্রাম্পের চেয়ে দ্বিগুণ খরচও করেছেন হ্যারিস। তার এই খরচই কাজে আসতে পারে দোদুল্যমান রাজ্যগুলোর ভোটার দলে টানতে। বিজ্ঞাপনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে সেখানে হ্যারিসের পক্ষে ভোট দিতে পারেন ভোটাররা।