যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের পর নিজের আসন্ন প্রশাসন সাজানোয় মন দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই প্রশাসনে স্থান পেতে যাচ্ছেন ট্রাম্পঘনিষ্ঠ নানা মুখ। তাঁদেরই একজন তুলসী গ্যাবার্ড। তাঁকে জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক পদে বসাচ্ছেন ট্রাম্প। তবে ট্রাম্পের এই পছন্দ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। এমনকি তাঁর দল রিপাবলিকান পার্টির অনেকেই এ নিয়ে চটেছেন।
তুলসীর বয়স ৪৩ বছর। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম হিন্দু কংগ্রেস সদস্য। ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস সদস্য ছিলেন। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলীয় প্রাথমিক বাছাইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন। তবে পরে তিনি সরে দাঁড়ান। দুই বছর পর ২০২২ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টি ছাড়েন তিনি। দীর্ঘ সময় তুলসী মার্কিন সামরিক বাহিনীতেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ইরাক ও কুয়েত যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে চলতি বছরের আগস্টে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জানান তুলসী গ্যাবার্ড। গত অক্টোবরে নর্থ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যে ট্রাম্পের এক নির্বাচনী সমাবেশে রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের প্রচারশিবিরের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তুলসী।
জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালকের কাজ কী
জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইনটেলিজেন্স কমিউনিটি’র প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স প্রোগ্রামের দেখভাল করেন। পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কাউন্সিলের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ইনটেলিজেন্স কমিউনিটির প্রধান তথা গোয়েন্দা পরিচালক হলে তুলসী গ্যাবার্ডের অধীনে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ), কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো (এফবিআই), প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা, সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা, নৌবাহিনীর গোয়েন্দা, বিমানবাহিনীর গোয়েন্দা, মহাকাশবাহিনীর গোয়েন্দা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ ১৮টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও দপ্তর থাকবে।
সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে তুলসী একবার বলেছিলেন,২০১৭ সালে গোপনে সিরিয়া সফরে গিয়ে বাশার আল-আসাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিনি।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পর জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক পদটি সৃষ্টি করা হয়। ২০০৫ সালে প্রথম এ পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। দেশটির বর্তমান গোয়েন্দা পরিচালকের নাম এভ্রিল হেইনস। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। নিয়োগ পেলে তুলসী গ্যাবার্ড হবে দেশটির প্রথম নারী গোয়েন্দা পরিচালক।
গোয়েন্দা সংস্থায় তুলসীর অভিজ্ঞতা কী আছে
গোয়েন্দাসংক্রান্ত কোনো পদে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সরাসরি তুলসী গ্যাবার্ডের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আর এত দিন যাঁরা জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের মতো তুলসী কোনো জ্যেষ্ঠ সরকারি পদে আগে ছিলেন না। তিনি শুধু দুই বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক কমিটির সদস্য ছিলেন।
তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইনটেলিজেন্স কমিউনিটির বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সমালোচক হয়ে উঠেছেন তুলসী। অন্য কোনো দেশে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন তিনি। মোদ্দাকথা, বিশ্বের অন্য কোথাও চলা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যেন হস্তক্ষেপ না করে, সে বিষয়ে সোচ্চার থেকেছেন তুলসী।
রাশিয়া-ইউক্রেন
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। এর তিন দিন পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পোস্ট দিয়ে তুলসী বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইউক্রেনের ‘ভূরাজনীতি থেকে দূরে থাকা উচিত’। আর ন্যাটোর মতো কোনো সামরিক জোটের সদস্য নয়, বরং ইউক্রেনকে একটি ‘নিরপেক্ষ’ দেশ হিসেবে মেনে নেওয়া উচিত।
সে বছরের মার্চ মাসে এক্সে আরেকটি ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন তুলসী। তাতে বলেছিলেন, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে নির্মিত ২৫টির বেশি জৈব–গবেষণাগার রয়েছে। এর আগে রাশিয়াও একই অভিযোগ তুলেছিল। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন। এ অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীরা একটি ‘কট্টর ইসলামপন্থী সংস্থার হাতের পুতুল’ বলে উল্লেখ করেছেন তুলসী গ্যাবার্ড।
তুলসীর ওই পোস্টের পর যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে এ নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন রিপাবলিকান সদস্যরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রতিনিধি পরিষদের সাবেক সদস্য অ্যাডাম কিনজিঞ্জারও। তিনি বলেছিলেন, তুলসীর ওই বক্তব্য ‘বিশ্বাসঘাতকতামূলক’। তিনি রাশিয়ার ‘অপপ্রচারের’ সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন। একই কথা বলেছিলেন সিনেটর মিট রমনিও।
সিরিয়া
২০১১ সালে সিরিয়া যুদ্ধ শুরু হয়। এর নেপথ্যে ছিল আন্দোলনকারীদের ওপর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের দমন–পীড়ন। পরে ওই আন্দোলন বিদ্রোহে রূপ নেয়। তা থেকেই শুরু হয় সশস্ত্র যুদ্ধ। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ছিলেন তুলসী গ্যাবার্ড।
সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের বিরোধীদের সাহায্য করেছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সরকার। এ জন্য ২০১৫ সালে ওবামার সমালোচনা করেছিলেন তুলসী। আর সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে একবার বলেছিলেন, ২০১৭ সালে গোপনে সিরিয়া সফরে গিয়ে বাশার আল-আসাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিনি। তুলসী আরও বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ নয়, বরং সিরিয়ার মানুষকেই তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে দিন।’
ইরান
২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর প্রথম মেয়াদের শেষ বছরে এসে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তখন এক গোয়েন্দা ব্রিফিংয়ে তুলসী গ্যাবার্ড বলেছিলেন যে ট্রাম্প প্রশাসনের এই কর্মকাণ্ডের ‘কোনো যৌক্তিকতা নেই’।
সিএনএনের এক সাক্ষাৎকারে তুলসীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তায় ইরান কোনো হুমকি সৃষ্টি করছে কি না? জবাবে তিনি বলেছিলেন, প্রশ্নটা এমন হওয়া উচিত ছিল যে, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কি আগের চেয়ে ভালো হয়েছে? তখন জবাবটা হবে, ‘না’।
ভারত
ভারত সরকার ও দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তুলসী গ্যাবার্ডের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মোদির সঙ্গে কয়েকবার দেখাও করেছেন তিনি। সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্টারসেপ্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৯ সালে প্রতিনিধি পরিষদ নির্বাচনের সময় তুলসীর প্রচারশিবিরে অনুদান দিয়েছিলেন হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শতাধিক ব্যক্তি। এই দলে মোদির বিজেপির লোকজনও রয়েছেন।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ভারতের উত্তর প্রদেশের বারানসিতে অনুষ্ঠিত প্রবাসী ভারতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি করা হয়েছিল তুলসী গ্যাবার্ডকে। প্রতিবছর ভারত সরকার এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। তবে তুলসী ভারতীয় বংশোদ্ভূত নন।
জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক পদের জন্য তুলসীর যোগ্যতার ঘাটতি রয়েছে। সিনেটে তাঁর নিয়োগের অনুমোদনের সময় বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।
মার্ক ক্যানসিয়ান, জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ
এমন সময় তুলসীকে গোয়েন্দা পরিচালক হিসেবে ট্রাম্প বেছে নিয়েছেন, যখন মাসখানেক আগেই ভারতের সাবেক এক গোয়েন্দা সদস্যকে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় বংশোদ্ভূত শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ভারতের ওই গোয়েন্দা।
পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ নিয়ে তদন্তের সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছে দেশটির ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ও এফবিআই। জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক হলে এই দুটি সংস্থা শিগগিরই তুলসী গ্যাবার্ডের অধীনে আসবে।
ইসরায়েল ও গাজা
গত বছরের অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজায় চলছে যুদ্ধ। ইসরায়েলের হামলার মুখে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন উপত্যকাটির বাসিন্দারা। এরই মধ্যে বিগত কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভ হয়েছে। এসব বিক্ষোভকারী একটি ‘কট্টর ইসলামপন্থী সংস্থার হাতের পুতুল’ বলে উল্লেখ করেছেন তুলসী গ্যাবার্ড।
এক বছরের বেশি সময় ধরে চলমান যুদ্ধে গাজায় ৪৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। তারপরও এই যুদ্ধের প্রতি সমর্থন রয়েছে তুলসীর। যুদ্ধবিরতির পক্ষে কথা বলতেও দেখা যায়নি তাঁকে। গত ফেব্রুয়ারিতে ইউটিউবে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে তুলসী বলেছিলেন, হামাস একটি হুমকি। তাদের সামরিক ও আদর্শগত দিক দিয়ে পরাজিত করতে হবে।
তুলসীর নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক কেন
তুলসী গ্যাবার্ডকে গোয়েন্দা পরিচালক পদে বেছে নেওয়ার পর কংগ্রেসের অনেকেই এ নিয়ে সমালোচনা করেছেন। যেমন প্রতিনিধি পরিষদে ডোমোক্রেটিক পার্টির সদস্য ও সিআইএর সাবেক কর্মকর্তা অ্যাবিগালি স্প্যানবার্জার বলেছেন, তুলসী শুধু এই পদের জন্য অযোগ্যই নন, তিনি বাশার আল-আসাদ ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো স্বৈরশাসকের ঘনিষ্ঠও।
ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারে তুলসীর সহায়তার জন্যই তাঁকে গোয়েন্দা পরিচালক পদে নিয়োগ দিয়ে পুরস্কৃত করা হচ্ছে বলে মনে করেন ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মার্ক ক্যানসিয়ান। তাঁর ভাষ্যমতে, এই পদের জন্য তুলসীর যোগ্যতার ঘাটতি রয়েছে। সিনেটে তাঁর নিয়োগের অনুমোদনের সময় বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।
তবে গোয়েন্দা পরিচালক পদে তুলসীকে বেছে নেওয়াটা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা নীতিতে কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে না বলে মনে করেন মার্ক ক্যানসিয়ান। তিনি বলেন, ইউক্রেন, ইসরায়েল, ইরান ও চীনের বিষয়ে মার্কিন প্রশাসন বৃহৎ পরিসরে যে নীতি বেছে নেবে, তারই ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তৎপরতায় পরিবর্তন আসবে।