‘যা খুশি করার’ সুযোগ রেখে ট্রাম্পের মন্ত্রিসভা

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ২২:৫৩
আপডেট  : ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩:০০

নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেননি, প্রস্তুতি হিসেবে তাঁর আগামী প্রশাসনের সদস্যদের নাম ঘোষণা শুরু করেছেন। আর তাতেই গোল বেধেছে। নানা মহলে তাঁর ক্যাবিনেটের (মন্ত্রিসভা) প্রস্তাবিত সদস্যদের যোগ্যতা ও আগের ইতিহাস নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

বিতর্ক ও সমালোচনা অবশ্য ট্রাম্পের প্রথম ক্যাবিনেট নিয়েও বিস্তর ছিল। সে-যাত্রায় তাঁর ক্যাবিনেটের অন্তত ১৫ জন্য সদস্য আইনগত ও নৈতিক ঝামেলায় পড়েছিলেন। তাঁদের কেউবা উৎকোচ গ্রহণ, সরকারি অর্থের অপচয় ও ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার, অথবা আইনভঙ্গ করে লবিং করার অভিযোগে পড়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে পরিবেশবিষয়ক দপ্তরের মন্ত্রী স্কট প্রুয়িট ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে পদত্যাগে বাধ্য হন। তহবিল তছরুপের অভিযোগে পদত্যাগে বাধ্য হন অভ্যন্তরীণ দপ্তরের মন্ত্রী রায়ান জিঙ্কে। নিজের পরিবারের সদস্যদের অন্যায়ভাবে ব্যবসায়িক সুবিধা জুগিয়েছেন, এমন অভিযোগে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মুখে পড়েন পরিবহনমন্ত্রী ইলেইন চাও।

নিজের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভার জন্য ট্রাম্প এখন পর্যন্ত ডজনখানেক নাম প্রস্তাব করেছেন। সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের তিনি মনোনয়ন দিয়েছেন, এ কথা কেউ বলবে না। যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতার বদলে তিনি জোর দিয়েছেন তাঁর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের ওপর। তাঁদের কেউ কেউ এতটা বিতর্কিত যে তাঁরা সিনেটের অনুমোদন না-ও পেতে পারেন। সে কারণে অনুমোদন এড়িয়ে সিনেটের বিরতির সময় তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিযুক্তি প্রদানের ইঙ্গিত দিয়েছেন ট্রাম্প।


একই রকম বিস্ময় ও বিরক্তির কারণ হয়েছে জাতীয় গোয়েন্দা দপ্তরের পরিচালক হিসেবে সাবেক কংগ্রেস সদস্য তুলসি গ্যাবার্ডের মনোনয়ন। ডেমোক্র্যাট হিসেবে নির্বাচিত এই কংগ্রেস সদস্য পরে রিপাবলিকান দলের সঙ্গে যুক্ত হন ও ট্রাম্পের মস্ত সমর্থক বনে যান।


এখন পর্যন্ত যাঁদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে ফ্লোরিডা থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য ম্যাট গেটজ, যাঁকে তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের সঙ্গে যৌনাচার ও নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত এই অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে তিন বছর ধরে বাইডেন প্রশাসনের বিচার বিভাগ তদন্ত চালায়, কিন্তু কোনো অভিযোগপত্র দাখিল করেনি। অনৈতিক আচরণের জন্য রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসও তাঁর ব্যাপারে তদন্ত চালিয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে তাঁর নাম প্রস্তাব করার পরপরই গেটজ নিজ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন, ফলে কংগ্রেসের সে তদন্তেরও ইতি পড়ে। কংগ্রেসে ট্রাম্পের সবচেয়ে অনুগত একজন সদস্য হিসেবে পরিচিত গেটজ সাবেক রিপাবলিকান স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থিকে বহিষ্কারে নেতৃত্ব দেন, সে জন্য দলের ভেতরে তিনি প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েন।

রিপাবলিকান দলেরই একাধিক সদস্য গেটজের এই মনোনয়নে বিস্ময় ও বিরক্ত প্রকাশ করেছেন। তাঁদের অন্যতম হলেন সিনেটের সুসান কলিন্স। তাঁর বিরুদ্ধে এত অভিযোগ রয়েছে যে সেসব প্রশ্ন এড়িয়ে গেটজ সিনেট কর্তৃক অনুমোদিত হবেন কি না, সে ব্যাপারে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন। আরেক রিপাবলিকান সিনেটর লিসা মুরকাউস্কি এই মনোনয়নে নাখোশ হয়েছেন।

 

এখন পর্যন্ত যাঁদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে ফ্লোরিডা থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য ম্যাট গেটজ, যাঁকে তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের সঙ্গে যৌনাচার ও নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত এই অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে তিন বছর ধরে বাইডেন প্রশাসনের বিচার বিভাগ তদন্ত চালায়, কিন্তু কোনো অভিযোগপত্র দাখিল করেনি।

 


একই রকম বিস্ময় ও বিরক্তির কারণ হয়েছে জাতীয় গোয়েন্দা দপ্তরের পরিচালক হিসেবে সাবেক কংগ্রেস সদস্য তুলসি গ্যাবার্ডের মনোনয়ন। ডেমোক্র্যাট হিসেবে নির্বাচিত এই কংগ্রেস সদস্য পরে রিপাবলিকান দলের সঙ্গে যুক্ত হন ও ট্রাম্পের মস্ত সমর্থক বনে যান। বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সব সামরিক অভিযানের বিরোধী গ্যাবার্ড ইতিপূর্বে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পক্ষে ওকালতির জন্য পরিচিত। কংগ্রেস সদস্য ড্যান কিল্ডি বলেছেন, ওর নাম দেখে আমি তো আকাশ থেকে পড়েছি।

পরবর্তী সেক্রেটারি অব স্টেট বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ট্রাম্প মনোনীত করেছেন ফ্লোরিডার অতিরক্ষণশীল সিনেটর মার্কো রুবিওকে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে তিনি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বাছাইপর্বে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সে সময় তিনি ট্রাম্পের বিচারবুদ্ধিসহ নানা বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। রুবিওর কথায় ট্রাম্প একজন প্রতারক। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অবশ্য রুবিও ট্রাম্পের একজন অনুগত সমর্থক বনে গেছেন। সিনেটে রুবিও তাঁর চীনবিরোধিতার জন্য পরিচিত। তিনি তাইওয়ানে অস্ত্র পাঠানোর প্রস্তাব করে চীনের বিরাগভাজন হয়েছেন। বেইজিং রুবিওর ওপর এতটাই ক্ষিপ্ত যে চীনে তাঁর সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
সে সময় তিনি ট্রাম্পের বিচারবুদ্ধিসহ নানা বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। রুবিওর কথায় ট্রাম্প একজন প্রতারক। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অবশ্য রুবিও ট্রাম্পের একজন অনুগত সমর্থক বনে গেছেন।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন ফক্স নিউজের সুপরিচিত হোস্ট পিট হেগসেথকে। তিনি সাবেক সেনাসদস্য, আফগানিস্তান ও ইরাকে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা তাঁর রয়েছে। কিন্তু প্রতিরক্ষা দপ্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও বড় দপ্তর পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতাই তাঁর নেই। একজন সাবেক জেনারেল হেগসেথের মনোনয়নের ব্যাপারে বলেছেন, পুরো ব্যাপারটাই একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো। তবে কেউ কেউ বলছেন, লোকটি সুদর্শন, ট্রাম্পের কাছে সেটাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

আরও একটি বিতর্কিত মনোনয়ন হলেন আরকানসর সাবেক গভর্নর মাইক হাকাবি। তাঁকে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন ট্রাম্প। ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসনের কট্টর সমর্থক হিসেবে পরিচিত হাকাবি পুরো ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের পূর্ণ সার্বভৌমত্বের সমর্থক। ইতিপূর্বে তিনি জানিয়েছেন, ‘ফিলিস্তিনি’ বলে কিছু আছে বলে মনে করেন না। তাঁর কথায়, পুরো ফিলিস্তিন প্রশ্নটি আসলে একটা ষড়যন্ত্র, যার একমাত্র লক্ষ্য ইসরায়েলের ন্যায্য ভূখণ্ড ছিনিয়ে নেওয়া।

হাকাবির মনোনয়নে ব্যাপক ক্ষিপ্ত হয়েছেন ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত লুইস মরেনো। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকালে হাকাবির সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হয়েছে। মরেনো বলেন, ‘এই লোকটা ইসরায়েলের ব্যাপারে শুধু ফ্যানাটিক বা ধর্মান্ধ নয়, ও আস্ত পাগল।’

শুধু মাইক হাকাবি নন, ট্রাম্প এ পর্যন্ত যাঁদের নাম প্রস্তাব করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই ‘কট্টর ইসরায়েল সমর্থক’ হিসেবে পরিচিত। এ কথা জানিয়েছে ইহুদি পত্রিকা ফরওয়ার্ড। তারা বলছে, রুবিও, হাকাবি, সিআইএপ্রধান জন র‍্যাটক্লিফ, অথবা সহকারী চিফ অব স্টাফ হিসেবে প্রস্তাবিত স্টিফেন মিলার—তাঁদের প্রত্যেকের পরিচয়, তাঁরা একদিকে ইসরায়েলের সমর্থক, অন্যদিকে ফিলিস্তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের বিরোধী। তাঁরা সবাই কট্টর ইরানবিরোধী হিসেবেও পরিচিত।


প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন ফক্স নিউজের সুপরিচিত হোস্ট পিট হেগসেথকে। তিনি সাবেক সেনাসদস্য, আফগানিস্তান ও ইরাকে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা তাঁর রয়েছে।


নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, নিজের ক্যাবিনেট সদস্য মনোনয়নের ব্যাপারে ট্রাম্প নির্ভর করছেন দুজন মিত্রের ওপর। তাঁদের একজন সুজি ওয়াইলস, যাঁকে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন এবং দ্বিতীয়জন বিশ্বের এক নম্বর ধনী ইলন মাস্ক, যাঁকে অপচয় রোধ ও প্রশাসন সংস্কারের লক্ষ্যে একটি নতুন দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। যাঁদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তাঁরা অনেকেই একসময় ট্রাম্পের তীব্র সমালোচক ছিলেন। কিন্তু গত চার বছরে তাঁরা সবাই মার-এ-লাগোতে এসে ট্রাম্পের হস্ত চুম্বন করে তাঁর আনুগত্য মেনে নিয়েছেন। ট্রাম্পের একজন মুখপাত্র বলেছেন, এই ক্যাবিনেটে কেবল তাঁরাই অন্তর্ভুক্ত হবেন, যাঁরা ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সমর্থক।

ট্রাম্প তাঁর প্রথম প্রশাসনে এমন অনেক ব্যক্তিকে বেছে নিয়েছিলেন, যাঁরা নিজ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও দক্ষ। তিনি যে ‘যা খুশি করার সুযোগ পাননি’, তার প্রধান কারণ এই লোকগুলো তাঁর খামখেয়ালিপনায় রাশ টেনে ধরেছিলেন। তাঁর চিফ অব স্টাফ জেনারেল জন কেলি বা প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল জন ম্যাটিস সেই রকম মানুষ ছিলেন, যাঁদের বলা হয় ‘অ্যাডাল্ট ইন দ্য রুম’। তবে মতান্তরের কারণে তাঁদের প্রায় সবাই অল্প সময় পরেই তাঁর প্রশাসন ছেড়ে চলে যান। এবারের ক্যাবিনেট মনোনয়ন থেকে স্পষ্ট ট্রাম্প তাঁর আশপাশে কোনো ‘প্রাপ্তবয়স্ক’কে চান না। ফলে ‘যা খুশি করায়’ তাঁকে আটকানোর আর কেউ থাকবে না।


তাঁর চিফ অব স্টাফ জেনারেল জন কেলি বা প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল জন ম্যাটিস সেই রকম মানুষ ছিলেন, যাঁদের বলা হয় ‘অ্যাডাল্ট ইন দ্য রুম’।